বিষাদ মাঝেমাঝে খুব জেঁকে বসে আমার মধ্যে। কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায় না তখন। ঘুরে বেড়ায় কাজের ফাঁকে, চারপাশে।
বলি, ভালোই তো আছি। মুখপানে চেয়ে বলে, ্তুনা না না্থ। আজ অনেকবছর পর ধূপের গন্ধ পেলাম। এই ঘ্রাণ আমার ভালো লাগে খুব। ছোটবেলায় বাবা যখন মাটির হাঁড়িতে কাঠকয়লা জ্বালিয়ে ধূপগুঁড়ো ছড়িয়ে দিতে দিতে এ ঘর, ও ঘর হাঁটাহাঁটি করতো আমি তখন সে ঘ্রাণে ডুব দিতাম। সন্ধ্যায় ধূপ জ্বালানোর নিয়ম ছিল আমাদের বাড়িতে। বাবারও নিশ্চয়ই ভালো লাগতো এই আগুনছোঁয়া ধূপের ঘ্রাণ। ধূপের ধোঁয়ায় হাওয়া দিতে দিতে সে হাওয়াটা নিজেই নাকের কাছে নিতো তা বেশ বুঝতে পারতাম।
খুব ছোটবেলা থেকেই ওই ঘ্রাণের প্রতি আমার নেশা ছিল । আরো কত কী নেশা যে তখন পেয়ে বসেছিল বয়সের সাথে ! সে’সব এখন পিছনের কথা। এখন কেন জানি মাঝেমাঝে পিছনে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হয় খুব। এটাই হয়তো মধ্য বয়সের এক দোষ।
যে সময়টাতে আসবার কথা ছিল বসন্ত , তখন নির্ভয়ে, নিঃসঙ্কোচে কাছে এসেছিল অবহেলা, তাচ্ছিল্য, ভর্ৎসনা। সে যে কারনেই আসুক তাদের আলিঙ্গন করে নিয়েছিলাম বুঝে না বুঝে। হয়তো ভালোবাসার কাঙাল বলে। একটু ভালোবাসুক, এর জন্যে অনেক কাঠখড়ও পোড়াতে হয়েছে । মঙ্গলময়ী গৃহিণীর ভূমিকায় নির্বিকারভাবে সব মানিয়ে নিয়েছি।
পুতুল খেলার সংসার সাজিয়ে রেখেছি নিত্যদিনের, নিজের মতো করে। সে সংসারের দিনযাপনের ব্যস্ততা নিয়েই থাকতে হতো খুব । তবুও কোথাও যেন মাঝেমধ্যে সংজ্ঞাহীন আবেগ সব এলোমেলো করে দিতো। জানালায় দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি ।পুতুল সংসারের উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। দমবন্ধ হয়ে আসে।
মন খারাপ হলেই বাড়ির ওই ধূপের ঘ্রাণই বাতাসে ভেসে উড়ে উড়ে নাকে এসে লাগতো। ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে উঠতো তখন।
ছোট্ট বারান্দা। মন ভালো না থাকলে এইখানটায় বসতে ইচ্ছে জাগে। আকাশ দেখতে পাই । ঋতুভেদে গল্প খুঁজি আকাশের। বর্ষা, শরৎ আর শীতে দারুণ গল্প জমা হয়। বাইরে আজ অনেকটা কোলাহলশূন্য। শব্দ কম। ইউটিউবে গান বেজেই যাচ্ছে।
‘কী সুর বাজে আমার প্রাণে আমিই জানি, মনই জানে।
কিসের লাগি সদাই জাগি, কাহার কাছে কী ধন মাগ্তি তাকাই কেন পথের পানে’।
এবার আলো আঁধারের খেলায় বিষাদকে পাশে বসতে দিই। আমার আনন্দনিবিড় দিনগুলোর গল্প শুরু করি। জোৎস্নারাতে তারা গুনেগুনে হিসেব কষতাম কে কতটা গুনতে পেরেছি। যার গননার পাল্লা ভারী তার ভালোবাসাও বেশি। প্রত্যেকবার প্রবাল হেরে যেতো।হেরে গেলেই সে আবার গুনতে শুরু করতো। খেলাটা চলতে থাকতো আর এলোমেলো দুষ্টোমিতে মন ভরে যেত।
এমন অনেক স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে মনে ! বিষাদ তখন বারবার বিষাদময় জীবনের দোলায় একটু একটু দোল দিতে থাকে। কথার পিঠে কথা ওঠে আসে। মন পোড়ে। চোখ ভিজে ওঠে। রঙিন দিনযাপনের রঙ হারিয়ে ফেলি।
ভেতরে ভেতরে অনর্গল ভাঙচুরের খেলা । বিষাদ যেন বিন্দুতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ঘুম নামে , নরম ঘুম, বিভোর স্বপ্নে ডুবিয়ে দিলো আমায়।
সেদিন আকাশ কালোমেঘে ছেয়ে গেছে। মনে হলো এখনি তোলপার করে বৃষ্টি নামবে।
এমন হওয়ার দিনক্ষণ নয় কিন্তু মাস হিসেবে। রাজ্যের সব ভার যেন সে বহন করে আছে ।
একধরনের অদ্ভুত শূন্যতা ভিতর বাহির তোলপার করে দিচ্ছে। বেশ ক’দিন নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া হলো। বোঝাপড়ার দিন বোধহয় এবার শেষ হয়েছে। ভালোই হয়েছে । নিজেকে ফিরে পাবার সুযোগ হয়েছে আবার।
রাত নেমেছে। হাইওয়ের ওপর দিয়ে দ্রুতবেগে বাস ছেড়ে যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা। দু’একটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে আরো দ্রুতবেগে যাচ্ছে। বাইরে ঠান্ডা বাতাস।
হাওয়ায় শোঁ শোঁ শব্দ জানালার কাছে আওয়াজ তোলে। গায়ের চাদরটা আরেকটু ভালে করে টেনে নিলাম। বেশি নড়াচড়া করা যাচ্ছিল না। পাশের সিটে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। নিজেকে গুটিয়ে আরো একটু সরিয়ে নিলাম। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। বেশির ভাগ যাত্রী ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার রাতটাই নির্ঘুম কেটে যাচ্ছে। কত বিচিত্র মানুষ আছে। এই ছোট্ট জীবনেও তাও অনেকটা দেখা হয়ে গেল। বাইরে তাকিয়ে আছি। আঁধারেরও নিজস্ব আলো আছে। কেমন যেন আলোছায়া খেলা। পাঁচ বছরের এই সংসার, কত কথাই না মনে পড়ছে। ভরা চাঁদের আলো নেই আজ । যে আলো দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুনগুনিয়ে গেয়ে যেতাম। আলো ক্ষীণ, তবুও কোথাই যেন এ সুর বেজে যাচ্ছে –
“যে পথে যেতে হবে, সে পথে তুমি একা
নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা’
দূরে, বহুদূরে দেখা যাচ্ছে নদী। চাঁদের ক্ষীণ আলোয় আবছায়ায়। এতো দুর্বল আগে কখনও অনুভব করিনি। এভাবে একা রাতের বাসে করে কোথাও যেতে হয়নি কখনও। প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সেই অন্ধকারের প্রাচীর ভেদ করে আজ আলোকিত হতে চলেছি। এবার শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। নিজের অজান্তেই নোনাজলে ভিজে যাচ্ছি। মাঝেমাঝে হেডলাইটের আলো চোখেমুখে পড়ছে। দূরের গাছগুলো হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাচ্ছি। সারি সারি গাছ। খুবই ধোঁয়াটে।
ধীরে ধীরে চাঁদের আলোও দূরে সরে মলিন হয়েছে। আলো আঁধারেরও রঙের খেলা শুরু হয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর রঙে ছেয়ে আছে ভোরের আলো।
এই মুহূর্তে অনেক রঙ আকাশের গায়ে। ভোরের সোনালি আলোটুকু এমনিই স্নিগ্ধ, মনোরম।
বাস থেকে নেমে রিকসায় চেপে যেতে যেতে দেখা হলো রাস্তার দু’পাশে লতাপাতার মাখামাখিতে নানান রঙের ফুল। শিম, কড়াইশুটি, আর হলুদ ফুলে ক্ষেত ভরে আছে। কিছু ফড়িং কচি সবুজপাতার ডগায় একবার বসছে তো আবার উড়ছে। ওদের এই ওড়াউড়ি খেলা দেখতে দেখতে একটা বাড়ির সামনে নামলাম। শান্ত , ছায়াঘেরা বাড়িটার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ির চারপাশটা দেখে খুব ভাল লাগলো।
ছোট্ট বাড়ি। সামনে এক চিলতে উঠোন। সে উঠোনের এক কোনে ছোট্ট সব্জির বাগান, ফলফলাদির গাছ। আর সেই ফলফলাদির গাছের ডালপালা জড়াজড়ি করে তার আলোছায়ায় পুকুরের জলের রঙ-ই বদলে দিয়েছে। বেশি ভাল লাগলো বাড়ির সামনেই শিউলিফুলের গাছ। আর সে গাছের ফুল পড়ে আছে উঠোনজুড়ে । এতো ক্লান্তিতেও ফুল কুড়িয়ে নিতে ভালো লাগছে খুব। ছোট বেলার সে চঞ্চলতা পেয়ে বসলো তখনি যেন। ফুলকুঁড়ানি’ নামই তো ছিল। ভোরে শিউলিতলার ফুল কুড়িয়ে ঝুড়িতে রেখে অন্যগুলো নিজের কাছে জমা রাখতাম মালা গাঁথার জন্যে। আহারে সময়!
আজ একাকী । তাড়াহুড়োর কোন বালাই নেই। অন্যদিনের ভোরের মতো আজকের সেই ভোর নয়। যে ভোর শুরু হতো অন্যদের ভালো রাখার তাড়াতে।আজ নিজের মতো করেই নিজেকে ভাবতে পারছি। যে জীবন এখন ফড়িঙের। রিংটোনের শব্দ। সারারাত মোবাইলে কোনো শব্দই নেই। খুঁজতে গিয়ে ব্যাগে এটা, ওটা সরিয়ে মোবাইল নিয়ে দেখতে পেলাম প্রবালের নাম্বার। ফোন বেজেই যাচ্ছে । সদর দরজা খোলার শব্দে ঘুড়ে দাঁড়ালাম। যেন দু’হাতে আলোর মশাল নিয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষায়। লতাপাতার ফাঁক গলে সোনারোদের আলো খেলা করছে দরজার ওপাশে।
বললাম, এবার আমার ঠিকানা পেয়ে গেছি প্রবাল!
পথেরও ভিন্নতা আছে । দেখো ঠিক ভাসতে ভাসতে আমি কূলের ঠিকানায় পৌঁছে যাব।
“অথচ আঁধার পেরোবার আগেই আমাকে আকাশভরা সূর্য্যেদয় দেখার কথা ছিল’-
এবার আমার ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নগুলোকে আত্মহত্যা করিয়ে ফিরে এলাম’।
অনেকদিনের তৃষ্ণার্ত বুকে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলাম যেন। দু’হাত বাড়িয়ে দিই আলোর দিকে।
‘সেই মেঘবালিকার গল্প হোক, শহরজুড়ে বৃষ্টি হোক, রোদ্দুর হোক আজ শুধুই তাহার ডাকনাম।’