২০১৪ সাল ইরানের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া একটা প্রাণদন্ডাদেশ বাতিল করার জন্য সারা বিশ্ব থেকে অজস্র মানবাধিকার সংগঠন সোচ্চার হয়, অনুরোধ আসে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রধানদের কাছ থেকে, অনুরোধ আসে অ্যামেনেস্ট্রি ইন্টারন্যাশানাল থেকে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রাণ বাঁচানোর শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। প্রাণ ভিক্ষার আবেদন জানিয়েছে খোদ ইরানেরও বহু নারী পুরুষ। এক কথায় পুরো বিশ্বের আবেদন নিবেদন অগ্রাহ্য করে সেই প্রাণদন্ড কার্যকর করে ইরান সরকার। সেই মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামি(?) ছিল একজন নারী। তার নাম রেহানে জাবারি। কি হয়েছিল তার সাথে? তার মায়ের কাছে লেখা তার জীবনের শেষ চিঠিটা আমরা পড়ে নেই। মায়ের কাছে রেহানে জাবারির শেষ চিঠি।
প্রিয় শোলেহ, আজ জানতে পারলাম এবার আমার কিসাস (ইরানের আইন ব্যবস্থায় কর্মফলবিষয়ক বিধি)-এর সম্মুখীন হওয়ার সময় হয়েছে। জীবনের শেষ পাতায় যে পৌঁছে গিয়েছি, তা তুমি নিজের মুখে আমায় জানাওনি ভেবে খারাপ লাগছে। তোমার কি মনে হয়নি যে এটা আমার আগেই জানা উচিত ছিল? তুমি দুঃখে ভেঙে পড়েছ জেনে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি। ফাঁসির আদেশ শোনার পর তোমার আর বাবার হাতে চুমু খেতে দাওনি কেন আমায়?
দুনিয়া আমায় ১৯ বছর বাঁচতে দিয়েছে। সেই অভিশপ্ত রাতে আমারই তো মরে যাওয়া উচিত ছিল, তাই না? আমার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলার কথা ছিল শহরের কোনো অজ্ঞাত কোণে। কয়েক দিন পর মর্গে যা শনাক্ত করার কথা ছিল তোমার। সঙ্গে এটাও জানতে পারতে যে হত্যার আগে আমাকে ধর্ষণও করা হয়েছিল। হত্যাকারীরা অবশ্যই ধরা পড়ত না, কারণ আমাদের না আছে অর্থ, না ক্ষমতা। তারপর বাকি জীবনটা সীমাহীন শোক ও অসহ্য লজ্জায় কাটিয়ে কয়েক বছর পর তোমারও মৃত্যু হতো। এটাই যে হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু সে রাতের আকস্মিক আঘাত সব কিছু ওলোটপালট করে দিল। শহরের কোনো গলি নয়, আমার শরীরটা প্রথমে ছুড়ে ফেলা হলো এভিন জেলের নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে, আর সেখান থেকে কবরের মতো এই শহর–এ রায় কারাগারের সেলে। কিন্তু এ নিয়ে অনুযোগ ক’রো না মা, এটাই নিয়তির বিধান। আর তুমি তো জানো যে মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না।
মা, তুমিই তো শিখিয়েছ অভিজ্ঞতা লাভ ও শিক্ষা পাওয়ার জন্যই আমাদের জন্ম। তুমি বলেছিলে, প্রত্যেক জন্মে আমাদের কাঁধে এক বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া থাকে। মাঝে মাঝে লড়াই করতে হয়, সে শিক্ষা তো তোমার থেকেই পেয়েছি। সেই গল্পটা মনে পড়ছে, চাবুকের ঝাপ্টা সহ্য করতে করতে একবার প্রতিবাদ জানানোর ফলে আরও নির্মমতার শিকার হয়েছিল এক ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়। কিন্তু প্রতিবাদ তো সে করেছিল! আমি শিখেছি, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অধ্যবসায় প্রয়োজন। তার জন্য যদি মৃত্যুও আসে, তাকেই মেনে নিতে হবে। স্কুলে যাওয়ার সময় তুমি শিখিয়েছিলে, নালিশ ও ঝগড়াঝাটির মাঝেও যেন নিজের নারীসত্তাকে বিসর্জন না দিই। তোমার মনে আছে মা, কত যত্ন করেই না মেয়েদের খুঁটিনাটি সহবত শিখিয়েছিলে আমাদের? কিন্তু তুমি ভুল জানতে মা। এই ঘটনার সময় আমার সেসব তালিম একেবারেই কাজে লাগেনি। আদালতে আমায় এক ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবে পেশ করা হয়। কিন্তু আমি চোখের পানি ফেলিনি। ভিক্ষাও করিনি। আমি কাঁদিনি কারণ আইনের প্রতি আমার অটুট আস্থা। কিন্তু বিচারে বলা হলো, খুনের অভিযোগের মুখেও নাকি আমি নিরুত্তাপ। আচ্ছা মা, আমি তো কোনোদিন একটা মশাও মারিনি। আরশোলাদের চটিপেটা না করে শুঁড় ধরে জানলার বাইরে ফেলে দিয়েছি। সেই আমিই নাকি মাথা খাটিয়ে মানুষ খুন করেছি! উল্টো ছোটবেলার ওই কথাগুলো শুনে বিচারপতি বললেন, আমি নাকি মনে মনে পুরুষালি। তিনি একবার চেয়েও দেখলেন না, ঘটনার সময় আমার হাতের লম্বা নখের ওপর কী সুন্দর নেল পালিশের জেল্লা ছিল। হাতের তালু কত নরম তুলতুলে ছিল। সেই বিচারকের হাত থেকে সুবিচার পাওয়ার আশা অতি বড় আশাবাদীও করতে পারে কি? তাই তো নারীত্বের পুরস্কার হিসেবে মাথা মুড়িয়ে ১১ দিনের নির্জনবাসের হুকুম দেওয়া হলো। দেখেছ মা, তোমার ছোট্ট রেহানে এই কয়েক দিনেই কতটা বড় হয়ে গিয়েছে। এবার আমার অন্তিম ইচ্ছেটা বলি শোনো। কেঁদো না মা, এখন শোকের সময় নয়। ওরা আমায় ফাঁসি দেওয়ার পর আমার চোখ, কিডনি, হৃদ্যন্ত্র, হাড় আর যা যা কিছু দরকার যেন আর কারও জীবন রক্ষা করতে কাজে লাগানো হয়। তবে যিনিই এসব পাবেন, কখনোই যেন আমার নাম না জানেন। আমি চাই না এর জন্য আমার সমাধিতে কেউ ফুলের তোড়া রেখে আসুক। এমনকি তুমিও নয়। আমি চাই না আমার কবরের সামনে বসে কালো পোশাক পরে কান্নায় ভেঙে পড়ো তুমি। বরং আমার দুঃখের দিনগুলো সব হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও। এই পৃথিবী আমাদের ভালোবাসেনি, মা। চায়নি আমি সুখী হই। এবার মৃত্যুর আলিঙ্গনে তার পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। তবে সৃষ্টিকর্তার এজলাসে সুবিচার আমি পাবই। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি অভিযোগের আঙুল তুলব সেই সমস্ত পুলিশ অফিসারের দিকে, বিচারকদের দিকে, আইনজীবীদের দিকে, আর তাদের দিকে যারা আমার অধিকার বুটের নিচে পিষে দিয়েছে, বিচারের নামে মিথ্যা ও অজ্ঞানতার কুয়াশায় সত্যকে আড়াল করেছে। একবারও বোঝার চেষ্টা করেনি, চোখের সামনে যা দেখা যায় সেটাই সর্বদা সত্যি নয়।
আমার নরম মনের শোলেহ, মনে রেখো সেই দুনিয়ায় তুমি আর আমি থাকব অভিযোগকারীর আসনে। আর ওরা দাঁড়াবে আসামির কাঠগড়ায়। দেখিই না, সৃষ্টিকর্তা কী চান! তবে একটাই আরজি, মৃত্যুর হাত ধরে দীর্ঘ যাত্রা শুরুর প্রাক মুহূর্ত পর্যন্ত তোমায় জড়িয়ে থাকতে চাই, মাগো! তোমায় যে খুব খু–উ–ব ভালবাসি।”
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সারবান্দী নামক এক লোককে হত্যা করার। এক ক্যাফেতে তাদের পরিচয় হয়। জাবারি তখন পড়া শেষ করে চাকরি খুঁজছিলো। সারবান্দী চাকরির আশ্বাস দিয়ে তার অফিসে দেখা করতে বলে। জাবারি তার অফিসে দেখা করতে গেলে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে তার সম্ভ্রম রক্ষার্থে সারবান্দীকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে আসে। সারবান্দীর মৃত্যু হলে জাবারিকে অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করে নির্জন কারাগারে রাখা হয় দুই মাস। কারো সাথে তাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে উকিলের সাথে দেখা করার অনুমতি মিলে। ২০০৯ সালে তেহরানের আদালত তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে জাবারি সারবান্দীকে আঘাত করার কথা স্বীকার করেছে কিন্তু দাবি করেছে এই হত্যা সে করেনি। অন্য কেউ এই হত্যা করেছে। ২৫ অক্টোবর ২০১৪ সালে গোহারদস্ত জেলে রেহানে জাবারির ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়।
নারী অধিকার আন্দোলনের বয়স দুশো বছরেরও বেশি। আমরা দৃশ্যত যা দেখি তাতে বলা যায় নারীর অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু কিছু দেশ বিশেষ করে মুসলিম কিছু দেশে যেমন ইরান,আফগানিস্তান, পাকিস্তানের মতো দেশে দুই তিন দশক আগের চেয়ে নারীদের অবস্থা খারাপের দিকে গিয়েছে।
এই কিছুদিন আগেও ইরানে মাশা আমিনী নামে এক তরুণীকে পুলিশী নির্যাতনে হত্যা করা হয় হিজাব সঠিকভাবে পরেনি বলে। যেসব রাষ্ট্র তার শাসন ব্যবস্থায় ধর্মকে যুক্ত করেছে সেসব রাষ্ট্রগুলোতে নারীরাই বেশি নিগৃহীত হয়। ধর্মের আইন কানুন নিয়মের বেড়াজাল শৃঙ্খল হয়ে নারীকেই চেপে ধরে। সারা বিশ্ব রেহানে জাবারির মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু স্বৈরশাসক তার রায় বহাল রেখে ন্যায় বিচারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করলো। তার প্রতি যে অন্যায় হয়েছিল, তাকে যে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিলো সেটাকে তো বিবেচনায় নেওয়া হলোনা! আত্মরক্ষার অধিকার ও স্বীকার করে না এমন রাষ্ট্রগুলো! কয়জন মাশা আমিনী, কয়জন রেহানে জাবারির কথা আমরা জানি?