একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। যেমন রোধ হচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা, তেমনি রেলপথেও থেমে নেই দুর্ঘটনা। থামানো যাচ্ছে না দুর্ঘটনায় আহতদের বা মৃত্যুর সারি। থামানো যাচ্ছে না আহাজারি। অসাবধানতা থেকে শুরু করে নানা কারণেই যখন দুর্ঘটনা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কতটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকে স্পষ্ট করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ময়মনসিংহগামী বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় নানা উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে যাত্রীদের মনে। বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের লাইনচ্যুত ৯টি বগির উদ্ধার কার্যক্রম যতদিন চলছিল, ততদিন প্রতিটি ট্রেনের শিডিউল ঠিক থাকেনি। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সব কটি ট্রেনের শিডিউল। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন হিসেবে রেলপথ সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও গড়ে উঠেছে আধুনিক রেল যোগাযোগব্যবস্থা। নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণের মাধ্যম হিসেবে রেল সবখানেই যাত্রীদের প্রথম পছন্দ। শুধু বাংলাদেশে রেলওয়েকে সব সময় চরম অবজ্ঞা করা হয়েছে। এখানে অনিয়ম–অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি যাত্রীসেবার মান তলানিতে এসে ঠেকেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিবছর রেলের সেবা সপ্তাহে কর্তৃপক্ষ যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও সার্বিক অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন আসে না। বস্তুত দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করা না হলে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রীসেবায় খুব একটা পরিবর্তন আসবে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, গত এক যুগে রেলে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে; চলমান রয়েছে আরও বিপুল অঙ্কের অর্থের উন্নয়ন প্রকল্প। তারপরও যাত্রীসেবার মান বাড়ছে না; দুর্ভোগ যেন যাত্রীদের নিত্যসঙ্গী। জরাজীর্ণ রেলপথ আর চরম ঝুঁকিতে থাকা লেভেল ক্রসিংয়ে প্রতিনিয়তই ঝরছে প্রাণ। তাঁরা বলেন, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দূর করার পদক্ষেপ না নিলে যত অর্থই বিনিয়োগ করা হোক না কেন, তার সুফল পাওয়া নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। অদক্ষতার কারণে সংশ্লিষ্টরা বরাদ্দকৃত অর্থ সময়মতো খরচও করতে পারেন না। দেশে ভয়াবহ যানজট, বেহাল সড়ক ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষাপটে রেল লাভজনক সংস্থায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এ সংস্থার রুগ্ণ দশাই কাটছে না। অন্যদিকে, ট্রেন দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, রেলপথ, রোলিং স্টক, সিগনালিং লেভেল ক্রসিং সংশ্লিষ্ট ত্রুটি, জনবল সংকটের কারণে ট্র্যাক, কোচ, ব্রিজ ইত্যাদি মেইনটেইন্যান্সের অভাব, অবৈধ লেভেল ক্রসিং গেট দিয়ে অনিয়ন্ত্রিত সড়কযান পারাপার, সচেতনতার অভাব, বাংলাদেশ রেলওয়েতে ইঞ্জিন বিকলতা, ট্রেন থেকে যাত্রী পড়ে যাওয়া বা লাফ দেওয়া, রেল লাইন ভেঙে যাওয়া, টেলিফোন ব্যবস্থার বিশেষ ক্ষতি হওয়া, পয়েন্ট ফেটে যাওয়া, ট্রেন পাটিং, লাইন চ্যুতি, রেলগাড়ি সংক্রান্ত হিংসাত্মক কার্যকলাপ, সড়কযানসহ লেভেল ক্রসিংয়ে কোনো বাধার ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়া, গরু–বাছুর জাতীয় প্রাণীর ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়া, বেশি বন্যার কারণে ট্রেন চলাচল বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ ইত্যাদি।
দু বছর আগে ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে ৬ পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেছিলেন তৎকালীন রেলপথমন্ত্রী। তাঁর দেওয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল– রেল সংক্রান্ত দুর্ঘটনা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে সমন্বিত ও কার্যক্রম পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ট্রেন ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটালাইজেশন করার প্রক্রিয়া চলমান রাখা; রেলট্র্যাক, রোলিংস্টক, ট্রেন অপারেশন, সিগনালিং সিস্টেম প্রভৃতি উন্নয়নে দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া, এ লক্ষ্যে ডিপিপি প্রণয়নের কাজ অব্যাহত রাখা। এছাড়া ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের আরও সচেতনভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য বিভিন্ন মোটিভেশনাল কার্যক্রম গ্রহণ করা; রেলপথের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং ওয়ার্কশপ আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আট বছরে শুধু ট্রেন দুর্ঘটনায় ২৫৩ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ১৯৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন রেলক্রসিংয়ে। একই সময়ে ট্রেনের ধাক্কা, লেভেলক্রসিং, আত্মহত্যাসহ বিভিন্নভাবে মারা গেছেন ৫ হাজার ৬০০ জন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রেল ভ্রমণে আর কোনো মানুষের প্রাণ যাক, তা আমরা চাই না। রেল ভ্রমণে মৃত্যু খুবই মানসিকভাবে আমাদের কষ্ট দিয়ে থাকে। তাই এ বিষয়ে জনবল বাড়িয়ে দুর্ঘটনা কমাতে হবে। একেকটি মৃত্যু একেকটি পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর তথ্য মতে, রেলপথ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় সাড়ে ৭০০ লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় হত্যার পর রেললাইনে লাশ ফেলা রাখা হয়। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
এদিকে রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম দাবি করেছেন, ‘কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনায় যে ব্যক্তি ফিশ প্লেট খুলছিলেন তিনি ধাওয়া খেয়ে ব্যাগ ফেলে পালিয়ে গেছেন। তার আইডি কার্ডসহ কাগজপত্র পাওয়া গেছে। তিনি মূলত কিছু টাকার বিনিময়ে এই কাজ করেছেন। আগুন সন্ত্রাসী বিএনপি ও তাদের সমর্থনকারী জামায়াত এই কাজগুলো করে।’ যদি রেলদুর্ঘটনাটি নাশকতামূলক হয়ে থাকে, তাহলে তা হবে আরো ভয়াবহ ও মারাত্মক। সেজন্য রেলভ্রমণের ক্ষেত্রে যাত্রীদের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অচিরেই গড়ে তুলতে হবে শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা।