দেশ থেকে প্রতি বছরই টাকা পাচারের ঘটনা বৃদ্ধির খবর পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন গবেষণা সংস্থাসহ কয়েকটি বিদেশী সংস্থা থেকে প্রতি বছরই এ বিষয়ে তথ্য দেয়া হয়। তথ্য প্রকাশের পর কিছু দিন হইচই করা হয়। এরপর অন্য ঘটনার মতো টাকা পাচারের মতো গর্হিত অপরাধের আলোচনাও থেমে যায়।
শ্রমবাজার হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি জনবল গেলেও এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স আসছে বেশি। রেমিটেন্স হিসেবে আসা এ অর্থ আগে পাচার হয়েছিল বলে সিপিডির ধারণা। সিপিডির কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২২–২৩ : তৃতীয় অন্তরবর্তীমূলক পর্যালোচনা’ জানাতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই ধারণা দেওয়া হয়। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হওয়া অর্থ রেমিটেন্স আকারে আসছে। তারা রেমিটেন্সে দেওয়া আড়াই শতাংশ প্রণোদনাও নিচ্ছে। এই প্রণোদনা নিতে তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স আনছে।
দৈনিক আজাদীর ২৮ মে তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে বলে আলোচনা রয়েছে। ৭ শতাংশ কর দিয়ে এই অর্থ ফেরত আনার সুযোগও দিয়েছে সরকার। তবে তাতে সাড়া মেলেনি। এদিকে বৈধ পথে রেমিটেন্স উৎসাহিত করতে কয়েক বছর ধরেই প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। এখন কেউ ১০০ টাকা রেমিটেন্স পাঠালে তা দেশে যিনি গ্রহণ করেন, তিনি পান ১০২ টাকা ৫০ পয়সা। এই সুযোগ অর্থ পাচারকারীরা নিচ্ছে বলে অনেকের সন্দেহ। রেমিটেন্স কোথা থেকে আসছে তা এখনই দেখা দরকার বলে মনে করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক। এদিকে নীতি–নির্ধারকদের দৃষ্টি দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনাতে আলাদা আইন কিন্তু রয়েছে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে প্রশাসনিক কঠিন উদ্যোগ নিতে হবে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২১ লাখ ব্যক্তি দেশের বাইরে গেছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে তথ্য দেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। এর মধ্যে ১১ লাখের বেশি সৌদি আরবে গেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু সৌদি আরব থেকে রেমিটেন্স কমছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাড়ছে। এ বিষয়ে খুব ভালোভাবে গবেষণা ও অনুসন্ধান হওয়া দরকার। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুরোধ করব, এর কারণ বের করতে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করার উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেন তিনি।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, দেশের অর্থনীতি নিয়ে সরকার এখন বেশ চাপে আছে। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, রেমিট্যান্সও কমে যাচ্ছে। রপ্তানি বাড়ছে, তবে সেরকম বাড়ছে না। তাই সরকার অনেকটা মরিয়া হয়ে উঠছে বাইরে থেকে রেমিট্যান্স আনতে। পাচার করা টাকা ফেরত আনতে। তবে তাঁরা মনে করেন, এতে খুব একটা কাজ হবে না। যারা টাকা পাচার করেন তারা দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য করেন না। আর পাচারের টাকা ফেরত আনলে যিনি আনবেন তিনি ট্র্যাকিং–এ পড়ে যাবেন। এর আগেও আন্ডার আর ওভার ইনভয়েসিং–এর অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা হয়েছে তাতে কাজ হয়নি। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েও কাজ হয়নি। আর এখন দেশের অবস্থাও তেমন ভাল না। টাকা দেশে আনলে সেটা নিরাপদ হবে কী না তাও যারা পাচার করেছেন তারা ভাববেন।‘
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অর্থ দেশ থেকে বেরিয়ে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন বা অসম্ভব। অর্থনীতিবিদরা একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এক্ষেত্রে যেচে কেউ নিজের দায় স্বীকার করবে না এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ নিয়ে কোনও কার্যকর আইন নেই। দেশকে নিয়ে পাচারকারীদের ভাবনা থাকলে সে অর্থ বিদেশে পাচার হতো না, দেশেই থাকতো। তার সাথে আছে নির্বাচন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন। টিউব থেকে একবার পেস্ট বেরিয়ে গেলে– তাকে যেমন ভেতরে প্রবেশ করানো যায় না, পাচারের অর্থও ব্যতিক্রমবাদে তা আর ফিরে আসে না।
অর্থ পাচার বিষয়ে কাজ করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলেজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সংস্থাটির পক্ষে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের প্রধান হিসেবে কাজ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এ বিষয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সংস্থাগুলো সরকারের অধীনে থাকলে তো তারা স্বাধীন হয়ে কাজ করতে পারে না। তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার করা যায় না। এখানে সংস্কার দরকার। রেমিটেন্স বেড়ে তা সংকটে থাকা রিজার্ভকে সহায়তা করবে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন।