রেমিটেন্স প্রবাহ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেলেও অর্থনীতিবিদদের কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। করোনাকালে অর্থনীতির মূল শক্তি হয়ে উঠেছে রেমিটেন্স। দেশের রিজার্ভও অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে এই ধারা অব্যাহত না থাকার শংকা প্রকাশ করে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। দেশে আটকা পড়া প্রবাসীদের ঠিকভাবে কর্মস্থলে পাঠানো ও স্থায়ীভাবে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হওয়া প্রবাসীদের আবারো বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়ার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এই উদ্যোগ যথাযথভাবে নেয়া না হলে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
সূত্র বলেছে, জানুয়ারি থেকে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে বিশ্ব অর্থনীতি সংকটে পড়তে শুরু করে। মার্চে করোনা সংক্রমণ চরম আকার ধারণ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বের বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও ধস নামে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নানা খাতও সংকটে পড়ে। শংকা প্রকাশ করা হয়েছিল প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স নিয়ে। কিন্তু সকল হিসেব নিকেশ পাল্টে দিয়ে রেমিটেন্স অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে শুরু করে। আত্মীয়-স্বজনের কাছে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ অর্থনীতির মূল শক্তি হয়ে উঠে। দেশে প্রতি মাসেই রেমিটেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিমাসেই তৈরি হচ্ছে রেকর্ড। গত বছরের তুলনায় এবার রেমিটেন্স ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের উচ্ছ্বসিত করে তোলে। রেমিটেন্সের এই জোয়ারের মাঝে চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩৯ দশমিক ৩১ বিলিয়ন অর্থাৎ ৩ হাজার ৯৩১ কোটি ডলারে। এরআগে আর কখনো দেশের রিজার্ভ এত উচ্চতায় উঠার রেকর্ড নেই বলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশে প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। বৈধ ও অবৈধভাবে বিশ্বের নানা দেশে বসবাসকারী এই বিপুল সংখ্যক প্রবাসীর অন্তত বিশ লাখ অবস্থান করেন সৌদি আরবে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতেও বিপুল সংখ্যক প্রবাসী চাকরি ও ব্যবসা বাণিজ্য করেন। প্রবাসীরা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ দেশে থাকা পরিবার পরিজনের কাছে প্রেরণ করেন। এটিই রেমিটেন্স হিসেবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার খাতকে সমৃদ্ধ করে। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ তাদের পরিবার পরিজন নানাভাবে খরচ করেন, বিনিয়োগ করেন। যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে গ্রামীন অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের ইতিবাচক প্রভাব বহু বছর ধরে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, করোনাকালে গত এপ্রিল থেকে দেশে রেমিটেন্স আসার পরিমাণ বাড়তে থাকে। সম্প্রতি রেমিটেন্সের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ৩ জুন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। ২৪জুন সেই রিজার্ভ আরো বেড়ে ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার অতিক্রম করে। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ৩০ জুন রিজার্ভ ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। গত ১ অক্টোবর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ হাজার ৯৩১ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর আগে আর কোনদিন দেশের রিজার্ভ এমন উচ্চতায় উঠেনি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাসে অর্থাৎ গত জুলাই মাসে দেশে রেমিটেন্স আসে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার। আগস্টে আসে ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স আসে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসীরা ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, রেমিটেন্স বাড়লেও বিশ্বের শ্রম বাজারের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ২০১৯ সালে সাত লাখের মতো কর্মী বিদেশে কাজ করতে যান। এর প্রায় ৯০ শতাংশ যান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। কিন্তু চলতি বছর এই সংখ্যা নগন্য। এবছর বিদেশ যাওয়া প্রবাসীর সংখ্যা এক লাখেরও কম। এছাড়া বহু প্রবাসী ফিরে এসেছেন। যারা ফিরে এসেছেন তাদের অন্তত এক তৃতীয়াংশ ফিরতে পারছেন না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রচুর প্রবাসী ফিরে এসেছেন। অনেকেই প্রবাসে নিজেদের অবস্থান নিয়েও শংকিত ছিলেন। তারা আসার সময় কিংবা শংকা থেকে নিজেদের যাবতীয় সঞ্চয় দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এতে করে রেমিটেন্স হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। কিন্তু আগামী মাসগুলোতে এধারায় বড় ধরনের ধসের আশংকা প্রকাশ করেন ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, পরিস্থিতি খুবই নাজুক। প্রবাসীদের অনেকেই ফিরে এসেছেন। অনেকেই চাকরি হারিয়ে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। অনেকেরই কাজ নেই। কবে কাজ পাবেন তারও কোন গ্যারান্টি নেই। এতে সামনের দিনগুলোতে রেমিটেন্সের পরিমাণ কমে যাবে।
এক্ষেত্রে বড় ধরনের ধস নামতে পারে মন্তব্য করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রবাসীদের কাছে সঞ্চিত প্রচুর অর্থ দেশে চলে এসেছে। করোনাকালে লকডাউনসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় হুন্ডির চেয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা বেশি এসেছে। আবার রেমিটেন্সের উপর সরকারের দেয়া দুই শতাংশ প্রণোদনাও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রচুর টাকা আসায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। কিন্তু এই ধারা সামনের মাসগুলোতে থাকবে না। ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রবাসীদের ভালো রাখার ব্যবস্থা করা না গেলে সংকট তীব্র হবে।
এবিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বলেন, রেমিটেন্স বেড়েছে। কিন্তু এটি স্বাভাবিক নয়। তিনটি বিশেষ কারণে রেমিটেন্স বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রবাসীদের অনেকেই বিদেশে থাকতে পারছেন না। থাকতে পারবেন না। তারা তাদের সঞ্চয়ের পুরো অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেয়ায় রেমিটেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এটি স্বাভাবিক নয়। হাজার হাজার প্রবাসী ফেরত যেতে পারছেন না। অন্তত তিন লাখ প্রবাসী চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরেছেন। তারা আর যেতে পারবেন বলে আপাতত মনে হচ্ছে না।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- হুণ্ডির প্রবণতা কমেছে। করোনাকালে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের তৎপরতা ছিল না। টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে। তাই রেমিটেন্স বেড়েছে। তৃতীয় কারণ হিসেবে সরকারের দুই শতাংশ প্রনোদনার কথা উল্লেখ করেন খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদ।
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, প্রবাসীদের অনেকের দোকান ছিল। বিক্রি করে দিয়ে চলে এসেছেন। কারো বাগান ছিল বিক্রি করে সব পুঁজি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। আবার কেউ কেউ থাকতে পারবেন না মনে করে সব সঞ্চয় দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এতে করে রেমিটেন্স বেড়েছে। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে রেমিটেন্সের এই প্রবাহ থাকবে না। আগামী দুই তিন মাসের মধ্যেই রেমিটেন্সের পরিমাণ কমতে শুরু করবে। হাজার হাজার মানুষের ফিরে আসার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রেমিটেন্সে। রেমিটেন্স প্রবাহে বড় ধরনের ধসের আশংকা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বছর শেষে এই প্রবৃদ্ধি থাকবে না। সৌদি আরব থেকে আরো বহু লোক ফিরে আসার আশংকা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি ভূ-রাজনৈতিক পলিটিঙের শিকার হতে যাচ্ছে। আমাদের পূর্বমুখী তৎপরতা অনেকেই পছন্দ করছেন না। এতে আমাদেরকে ঘায়েল করার জন্য নানা চেষ্টা করা হবে। যার ধকল যাবে জনশক্তি রপ্তানি খাতে। সৌদি আরব আমাদের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করবে বলে মনে হয় না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
রিজার্ভ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে। কমেছে আমদানি বাণিজ্য। ফলে টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। রিজার্ভ বাড়ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে বৈদেশিক কেনাকাটা শুরু হলে রিজার্ভের এই উচ্চতা থাকবে না।
অর্থনীতিবিদ ড.মইনুল ইসলাম বলেন, ফিরে আসা বা ফিরতে বাধ্য হওয়া কিংবা দেশে আটকা পড়া প্রবাসীদের আবার বিদেশ পাঠানোই সরকারের জন্য অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এদের ঠিকঠাকভাবে ম্যানেজ করা না গেলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অনেক বড় এই খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একইসাথে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি। তিনি প্রবাসীদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।