ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর পূর্তি হয়েছে। গত বছরের ৮ আগস্ট–কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গঠিত এই সরকার ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে যাত্রা শুরু করে। চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া ড. ইউনূসের এক বছরের সরকারের প্রধান কাজগুলো ছিল– ১. নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। ২. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা। ৩. দুর্নীতি দমনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ৪. বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেয়া। ৫.আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা। ৬. শিক্ষা ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। তবে এই এক বছরে সরকারের সাফল্য, ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা সবই ছিল। সরকার একটি শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কাজ করেছে এবং ইতিমধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংস্কারে মনোযোগ দিয়েছে।
গত এক বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাত কিছু ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা দেখালেও কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। একদিকে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় ও রিজার্ভ বেড়েছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা দেখা গেছে। সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও সংকট এখনো কাটেনি। তবে গত এক বছরে ডলারের দামে স্থিতিশীলতা এসেছে ও বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের কিছু কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে। আস্থার সংকট কেটে যাওয়ায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বেড়েছে। টাকা পাচার কমেছে। রপ্তানি আয় বেড়েছে তবে প্রবৃদ্ধি মন্থর। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং তারল্য সংকট (কিছু ব্যাংকের) ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা তৈরি করেছে। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হলেও সেবাখাতের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও সংকট এখনো কাটেনি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান।
এসব সত্ত্বেও নানা অর্থনৈতিক অন্তরায় এখনো বিদ্যমান। যেমন বাজারে চালের দাম এখনো কমেনি। প্রায় ৩০ লাখের মতো মানুষ কর্মহীন। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে আরো ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়তে পারেন। তবে আশার কথা হলো, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে। প্রবলেম ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক দ্রুত উন্নতি করছে। বিগত এক বছরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব একটা স্থিতিশীল হয়নি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেক্টরে চাঁদাবাজি, মব ভায়োলেন্স ও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ ও সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের তুলনায় উন্নতি হয়েছে এবং আরও উন্নতির দিকে যাচ্ছে। মব ভায়োলেন্সসহ অন্যান্য অপরাধও কমে আসছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুরো পুলিশ বাহিনীর স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সরকার বিরোধীদের ওপর দমন পীড়নে মানুষ পুলিশের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। উপরন্তু গত বছরের জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে নারী, শিশুসহ প্রায় দেড় হাজার ছাত্র–জনতা নিহত হন। গুরুতর আহত হয় অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। ফলে সরকার পতনের পর তীব্র গণরোষের ভয়ে দুই লাখের বেশি সদস্যের এই বাহিনীর প্রধান আইজিপি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত অনেকেই গা–ঢাকা দেন। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার পর পুলিশকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর কার্যক্রম শুরু করা হয়। তখন সেনাবাহিনীর সহায়তায় পুলিশি কার্যক্রম চলে। বর্তমানে সারা দেশেই পুলিশের কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আইন–শৃঙ্খলা রক্ষায় সক্রিয় ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনী। যদিও এখনো আইন–শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সেনাবাহিনী মাঠে রয়েছে।
গত এক বছরে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ এসেছে। নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে, যা নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন, পরীক্ষার পদ্ধতি এবং শিক্ষাখাতে বরাদ্দ নিয়েও আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। এই শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে এবং শিক্ষার্থীদের মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে সমস্যা সমাধান ও ক্রিয়াশীলতার ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তবে এই প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত কিনা এবং শিক্ষকরা নতুন পদ্ধতি কতটা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১ বছরের কাজের মূল্যায়ন করতে গেলে তাদের অবশ্যই প্রশংসা করতে হয়। তবে যত ভালো কাজ করুক না কেন গণতান্ত্রিক সরকারের বিকল্প তা কখনোই হতে পারে না। প্রধান উপদেষ্টা তা’ই করার চেষ্টা করছেন। আমরা তার প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট