মহাত্মা জীন হেনরী ডুনান্টের জন্ম হয়েছিল ১৮২৮ সালের ৮ই মে। সারা বিশ্বে ৮ মে তার জন্ম দিনকে ‘বিশ্ব রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস’ হিসেবে পালন করে। তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ সমাজসেবক, মানব হিতৈষী ও মহামানব। সেই জন্যই তিনি পেয়েছিলেন শান্তিতে প্রথম নোবেল পুরস্কার। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কোটি কোটি মানব সন্তান বিপন্ন মানবতার সেবায় নিয়োজিত। তিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষকে এক পতাকাতলে একই কর্মসূচীতে একত্রিত করেছিলেন। সাম্য মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন মানব সন্তানদের।
১৮৫৯ সালের ২৪ শে জুন তৎকালীন ইউরোপের দুই বৃহৎ শক্তি ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে ইতালীর এক পল্লী প্রান্তর সলফারিনোতে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ফরাসী বাহিনীর জয় হয়। মোট তিন লক্ষ সৈন্যের মাত্র ১৫ ঘণ্টা যুদ্ধে শুধু আহতদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২ হাজার। একদিকে বিজয়ী সৈন্যরা বিজয় উৎসবে মত্ত আর অন্যদিকে ৪২ হাজার আহত মানুষের মৃত্যু যন্ত্রণার আর্তনাদ। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। ঐ সময়ে ব্যবসা সংক্রান্ত জরুরি প্রয়োজনে তৃতীয় নেপোলিয়ানের সাথে দেখা করার জন্য ইতালীতে আগত সুইস যুবক হেনরী ডুনান্ট নিতান্ত কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রের এই মর্মান্তিকদৃশ্য অবলোকন করেন। মানব জীবনের প্রতি এই চরম অবজ্ঞা মানবসেবী ডুনান্টের হৃদয়ে দারুণভাবে রেখাপাত করে। তিনি তাৎক্ষণিক তার সকল কর্মসূচী বাতিল করে আহতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন।
১৮৬২ সালে হেনরী ডুনান্ট মর্মান্তিক এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে এ ‘মেমোরি অফ সলফেরিনো‘ নামে একটি বই লিখে বিশ্বব্যাপী আর্তের সেবামূলক নিরপেক্ষ একটি স্বেচছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আকুল আবেদন জানান। এই মহৎ কাজ তিনি আশানুরূপ সমর্থন পান। জেনেভার ‘পাবলিক ওয়েলফেয়ার সোসাইটি‘ সর্বপ্রথম এ আহবানে এগিয়ে আসে। হেনরী ডুনান্ট ও অপর চারজন মানব সেবীর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। যা ‘কমিটি অফ ফাইভ‘ নামে পরিচিত।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থন ও সহায়তার আশায় ১৮৬৩ সালের ২৬ অক্টোবর এই কমিটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহবান করে। মোট ১৬ টি দেশের প্রতিনিধি উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন ও হেনরী ডুনান্টের প্রস্তাব অনুযায়ী একটি আন্তর্জাতিক সেবামূলক নিরপেক্ষ সংস্থা গঠিত হয়। বর্তমান বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক মানব সেবা মূলক সংস্থা রেডক্রস এমনি ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে জন্ম লাভ করে।
তিনি ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে শান্তিতে প্রথম ‘নোবেল‘ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ শে অক্টোবর পূর্ব সুইজারল্যান্ডের হেইডনে ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
ব্রিটিশ ভারতে ভারতীয় রেডক্রস সোসাইটি গঠিত এ্যাক্ট, ১৯২০ এর অধীনে রেডক্রস সোসাইটি গঠিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার ফলে পাকিস্তানের ভৌগোলিক এলাকায় পূর্বের আইনের সামান্য রদবদল করে পাকিস্তান রেডক্রস সোসাইটি প্রাদেশিক শাখা গঠিত হয়। পাকিস্তান অংশে পাকিস্তান রেডক্রস সোসাইটি শাখা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান রেডক্রস সোসাইটি গঠিত হয়।
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান রেডক্রস সোসাইটির পূর্ব পাকিস্তান শাখা বাংলাদেশের জাতীয় রেডক্রস সোসাইটি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০ শে ডিসেম্বর, ১৯৭১ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট স্বীকৃতি লাভের জন্য আবেদন করা হয়। ৪ঠা জানুয়ারি, ১৯৭২ বাংলাদেশ সরকারের এক আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি গঠিত হয়। এরপর ৩১ শে মার্চ ১৯৭৩ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপ্রতি বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির আদেশ, ১৯৭৩ (পি.ও.-২৬) জারি করেন। এই আদেশের বলে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি এ্যাক্ট ১৯২০ বাতিল বলে গণ্য হয়। ২০ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ আন্তর্জাতিক রেডক্রসের ইরানের ‘তেহেরান সম্মেলনে‘ বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করে ।
১৯৮৮ সালে ৪ঠা এপ্রিল হতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির নামে পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি হয়।
বাংলাদেশের প্রতিটি প্রশাসনিক জেলায় ৬৪টি ও ৪টি সিটি করপোরেশনে ৪টি ইউনিট রয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সারাদেশ ব্যাপী নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। প্রতিটি ইউনিটে ১১ সদস্য বিশিষ্ট ইউনিট নির্বাহী পরিষদ এবং সোসাইটির নীতি নির্ধারণী কার্যক্রম পরিচালনায় পরামর্শ ও উপদেশ প্রদানের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট ব্যবস্থাপনা পর্ষদ কর্মরত আছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। তিনি তিন(৩) বছর মেয়াদে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে সরকার প্রধান সহযোগী ত্রাণ সংস্থা হিসেবে নিয়োজিত করেছে। সেহেতু, দেশের সার্বিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জাতীয় সদর দপ্তর সরাসরি এবং ইউনিটের মাধ্যমে বিপন্ন মানবতার সেবায় বিভিন্নমুখী কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। যেমন ক) দুর্যোগ ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম খ) ঘুর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপি) গ) স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ঘ) অনুসন্ধান ঙ) সমাজ ভিত্তিক দুর্যোগ মোকাবেলা কর্মসূচী (সিবিডিপি) চ) আইডি ছ) যুব কার্যক্রম জ) রক্তদান কর্মসূচি ঝ) বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক প্রকল্প ঞ) প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ট) ইফাদ ঠ) রেড ক্রিসেন্ট নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রচার এবং প্রসার ড) ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদান কর্মসূচী (ইপিআরপি) প্রভৃতি।
বর্তমানে কোভিড–১৯ মোকাবেলায় রেড ক্রিসেন্ট তৈরি করেছে আইসোলেশন ও ট্রিটমেন্ট সেন্টার। পাশাপাশি ক্যাম্প ও উখিয়া– টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় রেড ক্রিসেন্ট কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কাজ করছে। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। কক্সবাজারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে রেড ক্রিসেন্ট শুকনা খাবারসহ এক হাজার তাঁবু, মশারি ও কম্বল বিতরণ করে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে জরুরি সাড়াদানে প্রস্তুত রাখা হয় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ৩ হাজার ৩০০ প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজের (আইএফআরসি) সহযোগিতায় প্রশিক্ষিত এই স্বেচ্ছাসেবকেরা শিবিরের বাসিন্দাদের দুর্যোগপ্রস্তুতি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে।
কোভিড–১৯ মহামারির বিশ্বজুড়ে ক্রমবিস্তার মানুষকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দেয়। এই ১৫ মাসে সারা বিশ্বে ছত্রিশ লক্ষ মানুষ করোনার ছোবলে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে। বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় পঁয়ত্রিশ কোটির বেশি মানুষ। তবে আশার কথা যে, নানা দুর্যোগের শিকার বিপন্ন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে এ সোসাইটি।
লেখক : ম্যানেজিং বোর্ড মেম্বার, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট।