বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয় আসামির ফাঁসির রায় এসেছে। তবে চার আসামি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান গতকাল বুধবার দুপুরে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ছয় আসামির সবাইকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করেছেন তিনি। ১৫ মাস আগে পুরো দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা এই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল, তাদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জনের বিচার চলে এই আদালতে। মামলার ১ নম্বর আসামি রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩) বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে যে তিনজনকে রাম দা হাতে রিফাতকে কোপাতে দেখা গিয়েছিল, তাদের মধ্যে রিফাত ফরাজী একজন। আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। আসামি আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আঁকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২) এবং মো. হাসানকেও (১৯) একই সাজা দিয়ে আদালত বলেছে, হত্যাকাণ্ডের সময় তারা চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছিল। হত্যাকাণ্ডে তাদের সহযোগিতার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। রিফাতের স্ত্রী বরগুনার সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্রী মিন্নিকে হামলার মুখে স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছিল ভিডিওতে। তিনি ছিলেন মামলার এজাহারের এক নম্বর সাক্ষী। কিন্তু তদন্তের পর পুলিশ মামলার অভিযোগপত্রে মিন্নির নাম যুক্ত করে আসামির তালিকায়। রায়ে আদালত বলেছে, মিন্নিও যে তার স্বামীকে হত্যার ‘ষড়যন্ত্রে’ যুক্ত ছিলেন, প্রসিকিউশন তা ‘প্রমাণ করতে পেরেছে’। খবর বিডিনিউজের।
হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত অভিযোগপত্রের চার আসামি মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সায়মুনকে (২১) খালাস দিয়েছে। এই দশজনের মধ্যে মুসা পলাতক রয়েছেন। জামিনে থাকা মিন্নি রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। কারাগারে থাকা বাকি আসামিদেরও রায়ের সময় আদালতে হাজির করা হয়।
রায়ের জন্য সকাল ৯টার আগেই বাবা মোজাম্মেল হক কিশোরের মোটরসাইকেলে করে আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন জামিনে থাকা মিন্নি। রায়ের আগে বাবাকে বলছিলেন, খালাস পাবেন বলেই তার বিশ্বাস। কিন্তু রায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর মিন্নিকে কালো রঙের একটি মাইক্রোবাসে করে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে। দণ্ডিত বাকি আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর আদালতে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আমার মেয়ে ষড়যন্ত্রের শিকার। আমরা আপিল করব।
মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলামও আপিল করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেন, আমরা বলেছিলাম, রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এই রায়ে সংক্ষুব্ধ।
দণ্ডিত মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাতের বাবা দেলোয়ার হোসেন দাবি করেন, তার ছেলে জটলার মধ্যে ঘটনা দেখতে গিয়েছিল, হত্যাকাণ্ডে ‘ছিল না’। তিনি এই রায়ে বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন।
অন্যদিকে মামলার বাদী রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, মিন্নিসহ ছয় আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। আমরা এই রায়ে সন্তুষ্ট। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ভূবন চন্দ্র হাওলাদার বলেন, সাক্ষ্য প্রমাণে আমরা অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি বলেই আদালত ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন।
এদিকে রিফাত হত্যা মামলার রায় দেশের অন্যান্য আলোচিত মামলায় প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। তিনি বলেন, এ রায় নিঃসন্দেহে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
যে কারণে খালাস পেলেন চার আসামি : রিফাত হত্যা মামলায় ৪ জনকে খালাস দেয়া হয়েছে। তবে তারা কেন খালাস পেয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে খালাসপ্রাপ্ত কামরুল ইসলাম সাইমুনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, তারা ন্যায়বিচার চেয়েছেন এবং তা পেয়েছেন। তিনি বলেন, সাইমুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ২৬ তারিখ রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার ওই ঘটনার পরে রিফাত ফরাজী তাকে ফোন দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে বলেন। সাইমুন সেই মোটরসাইকেল নিয়ে সেখানে যান এবং চাবি ও মোটরসাইকেল দিয়ে আসেন। সেই মোটরসাইকেলে রিফাত ফরাজী তার ছোট ভাই রিশান ফরাজী ও নয়ন বন্ড পালিয়ে যান। এটা হলো সাইমুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ। কিন্তু কোনো মোটরসাইকেল এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধার করতে পারেনি। পাশাপাশি সাইমুন যে মোটরসাইকেল চালাতে পারে, তার যে মোটরসাইকেল ছিল বা তিনি যে মোটরসাইকেল দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, এ বিষয়গুলো প্রসিকিউশন থেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। এছাড়া সাগরের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, একটি স্ট্যাটাস দিয়ে সকাল ৯টায় একটি জায়গায় সবাইকে যেতে বলা হয়েছে আর সাগর সেখানে ইমোজি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তার ওখানে কোনো পার্টপ্লে কিংবা কলেজে যাওয়া কিংবা ভিডিওতে দেখা যায়নি। এছাড়া প্রসিকিউশন থেকে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় তাকেও খালাস দিয়েছেন আদালত।
রাফিউল ইসলাম রাব্বির বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, কলেজ পড়ুয়া এক বন্ধু ওই ঘটনার পর তার বাসায় গিয়েছিল। কিন্তু রাব্বি এ ঘটনার খবর তখন জানতেন না। তাই স্বাভাবিকভাবে তার একটি ফ্রেন্ড এসে রাতে রয়েছে। কিন্তু যখন প্রকাশিত ওই ভিডিওটি ভাইরাল হয়, তখন ওই আশ্রিত বাসা থেকে চলে যায়। কিন্তু রাব্বির কোনো ইনটেশন ছিল না ওই বন্ধুকে আশ্রয় দেওয়ার। ফলে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। এছাড়া পলাতক আসামি মুসার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগও প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি।
উল্লেখ্য, গত বছর ২৬ জুন ভরদুপুরে বরগুনা জেলা শহরের কলেজ রোডে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাতকে। ওই ঘটনার একটি রোমহর্ষক ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা। ওই ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে মামলায় ১ নম্বর সাক্ষী করা হয়। এর মধ্যেই ২ জুলাই মামলার প্রধান সন্দেহভাজন সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এদিকে মিন্নির শ্বশুরই পরে হত্যাকাণ্ডে পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তুললে আলোচনা নতুন মোড় নেয়। ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে সেদিন রাতে তাকে রিফাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তবে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর অভিযোগ করেন, ‘নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে’ মিন্নিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে পুলিশ। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত আছে বলেও সে সময় দাবি করেন তিনি।