বিশ্বকবি রবিঠাকুরের ‘ন্যায়দণ্ড’ কবিতার পংক্তি উপস্থাপনে নিবন্ধের নান্দীপাঠ করছি- ‘ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা, হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা তোমার আদেশে।/ যেন রসনায় মম সত্যবাক্য ঝলি উঠে খরখড়গসম তোমার ইঙ্গিতে।/ যেন রাখি তব মান তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান ॥/ অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে ॥’ সাম্প্রতিক কালে নারী-শিশু-কিশোরীর প্রতি কুৎসিত সহিংসতা পুরো সমাজকে কঠিন ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। গুটিকয়েক অপরাধীর জন্য পুরো জাতি-রাষ্ট্র দায়ী হবে; তা কখনো মেনে নেওয়া যায় না। সরকার ও আপামর জনগণের সচেতন শক্তিতে এই পৈশাচিক যৌনাচার ও ঘৃণ্য পাশবিকতা সমূলে নির্মূল করার অপরোক্ষ উদ্যোগ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে ইতিহাসের অধ্যায়ে অপরাধীদের মতো আমরাও একই পর্যায়ে দণ্ডিত হব- এতে সন্দেহ ও সংশয়ের কোন অবকাশ নেই।
বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের দুঃসহ বিস্তার ও নির্দয় প্রাণ সংহারে ক্ষত-বিক্ষত মানব হৃদয় সম্ভাব্য চলমানতা নিয়ে চরম উদ্বিগ্নে দিনানিপাত করছে। এরই মধ্যে করোনা মহামারির চেয়েও বীভৎস দৃশ্যপট তৈরি করে ধর্ষণ-নারী নির্যাতন-নারী ও শিশুর প্রতি নৃশংস আচরণ বিকৃত অপসংস্কৃতির নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। যদিও নারী ও শিশুর প্রতি এ ধরনের নিষ্ঠুরতা সুদীর্ঘ প্রাচীন অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে, সমসাময়িক পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় এর ভয়ঙ্কর পীড়ন কল্পনাতীতভাবে অতীতের সকল কলুষিত চিত্র পাল্টে দিয়েছে। আমরা জানি যে, সংস্কৃতি মানুষের জীবনপ্রবাহ ও সভ্যতার আদর্শ নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আদি থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত সকল নান্দনিক-সৃজনশীল-মননশীল এবং মানবকল্যাণ উপযোগী সামগ্রিক সৃষ্ট কর্মই সংস্কৃতির অবগাহনে পরিশুদ্ধ। নৃবিজ্ঞানী টেইলারের মতে, “সমাজের সদস্য হিসাবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা এবং জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি-আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয় হলো সংস্কৃতি।” নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে মানব সৃষ্ট সব কিছুকেই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর বিপরীতে রাষ্ট্রীয় আইনবিরোধী; নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত অসামাজিক কার্যকলাপ কদাচার-পাপাচার অপসংস্কৃতির দুর্বিনীত উপাদান হিসেবে প্রতত।
ধর্ষণ-নারী নির্যাতন-নারী ও শিশুর প্রতি প্রহরণ-কিশোর অপরাধ-চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি-ছিনতাই-জালিয়াতি-প্রতারণা-দুর্নীতি-অপকর্ম-সন্ত্রাস-হত্যা-আত্মহত্যা-অনিয়ম-জঙ্গি কর্মকাণ্ড-বাড়ি ও ভূমি দখল ইত্যাদি চরম সমাজ ও আইন বহির্ভূত কর্মযজ্ঞ যে কোন সমাজে চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব প্রতিরোধে দেশের সমগ্র নাগরিক পবিত্র সংবিধানসম্মত অধিকার সুরক্ষায় আইনের যথার্থ কার্যকর; সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে উল্লেখিত কদর্য নষ্টামি বিনাশ করা না গেলে সমাজ-জাতি-রাষ্ট্রের সকল উন্নয়ন-অর্জন ম্লান হয়ে যাবে এবং দেশ ধ্বংসের তলানিতে গিয়ে পৌঁছুবে। কোন ধরনের পারস্পরিক ব্যক্তি-গোষ্ঠী-দলগত দোষারোপ নয়; অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনায় অনুকম্পা-পৃষ্ঠপোষকতা-আশ্রয়-প্রশ্রয় নিধন করে শাস্তির বিধান এবং সঠিক প্রয়োগের বিঘোষণ বাঞ্ছনীয়।
দেশবাসী নিগূঢ় পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করছে যে; দেশকে অস্থিতিশীল করার অসৎ উদ্দেশ্যে অশুভ-অন্ধকারের ভয় অপশক্তি সুপরিকল্পিতভাবে তাদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। অবৈধ-অনৈতিক পন্থায় ব্যক্তি-গোষ্ঠী বা দলগত স্বার্থ উদ্ধারে এসব কর্মযজ্ঞ সংঘটিত করা হচ্ছে কিনা; তা নিরপেক্ষ-বস্তুনিষ্ঠ-সত্যনিষ্ঠ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা অতীব জরুরি। অপরাধী অবশ্যই অপরাধী। কিন্তু অপরাধ দমনের নামে কোন নির্দোষ-নিরীহ ব্যক্তি-নারী-শিশু ব্যক্তিগত আক্রোশ-ক্ষোভ ও ক্রোধের কারণে অহেতুক নিপীড়িত-নির্যাতিত হচ্ছে কিনা তারও সত্যতা নিশ্চিত ভজ্যমান। ইংরেজি নববর্ষ সূচনার প্রথম সপ্তাহের শেষান্তে রাজধানীর কলাবাগানে ও’লেভেলের এক কিশোরী যে জঘন্য-কুরুচিপূর্ণ যৌনাচারের শিকার হয়েছে তা ন্যূনতম বিবেকবান মানুষের মনেও গভীর রক্তক্ষরণের করুণ দৃষ্টান্ত হয়েছে। এই দুর্বিষহ ঘটনার জন্য যেই দায়ী হোক না কেন; তার হীন কৌশল অবলম্বন ও ঘটনা সংঘটিত করার ভাবনা-ধারণার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অপরিহার্য। ঘটনার প্রেক্ষাপট, দায়ী ব্যক্তি ও সহপাঠিদের আর্থসামাজিক পটভূমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-শিক্ষা কার্যক্রমের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যাসহ তার বেড়ে ওঠার সামগ্রিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার যথার্থ অনুসন্ধান বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ‘কেইস স্টাডি’ হিসেবে এই ধরনের কয়েকটি ঘটনাকেন্দ্রিক গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করে তার প্রাক্কলিত ফলাফল ও প্রভাব নিরূপণ এসব লুব্ধক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নির্ধারণে সহায়ক হবে।
বিজ্ঞজনের মতে, ব্যাপক জৈবিক-সাংস্কৃতিক-শ্রেণিগত ও নগর কেন্দ্রিক বিরাজিত আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের অসম কারণে উন্নত দেশগুলোতে ধর্ষণের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সহিংসতার মূলে পুরুষদের জৈবিক তাড়নার চেয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসংগতি প্রণিধানযোগ্য। অনেক ক্ষেত্রে নানামুখী সামাজিক কলঙ্ক মোচনের দায়মুক্তি হিসেবে ধর্ষণের ঘটনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকাশ পায় না বা করা হয় না। মূলত সামাজিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিন্ম আয়ের পেশাজীবী নারী-পোশাক শিল্প কর্মী-দরিদ্র স্বল্প শিক্ষিত ছাত্রী-গৃহবধূ-আদিবাসী নারী সবচেয়ে বেশি এ ধরনের পাশবিকতার শিকার। ২০১৮ সালের পুলিশ স্টাফ কলেজের গবেষণা অনুযায়ী ধর্ষিতা নারী ও শিশুদের ৭০ শতাংশ মাসিক উপার্জন বিহীন এবং ১৯.৪ শতাংশের মাসিক আয় ১০ হাজারেরও নিচে বা গড় মাসিক আয় মাত্র ২,৮৪১ টাকা। অতি দরিদ্রতার কারণে এদের মামলা দায়ের, বিচারিক কার্যক্রম ও ন্যায় বিচার প্রাপ্তি প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিগৃহীত। একই গবেষণাসূত্রে জানা যায় এসব ধর্ষকদের ১৪.৯ শতাংশ বিত্তশালী পরিবারের সন্তান, ৯.১ শতাংশ রাজনীতিবিদদের সন্তান বা আত্মীয় এবং ৪.৬ শতাংশ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী।
সচেতন মহলের অনেকাংশ মনে করেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই হার বৃদ্ধির পিছনে বহুলাংশে দায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৮ সালে পুলিশের কাছে নথিবদ্ধ অপরাধীর মধ্যে ৩৩.৪ শতাংশ অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়। বিপরীতে বাংলাদেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের ট্রাইব্যুনালে মাত্র ২.৬ শতাংশ মামলার চূড়ান্ত রায় হয়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা প্রক্রিয়া, তদন্ত, ধর্ষণের মেডিকেল রিপোর্ট ও কতিপয় আইনজীবীর অনাগ্রহ বা পক্ষপাত দুষ্টতার কারণে চূড়ান্ত রায়ে মামলা খারিজ হয়ে যায়। আইনগতভাবে তদন্ত কর্মকর্তাদের ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষে চূড়ান্ত চার্জশীট দেওয়ার কথা থাকলেও পুলিশের অধিক দায়িত্বভার বা পক্ষপাত দুষ্টের কারণে অথবা প্রশাসনিক মহলের চাপে মামলার চার্জশীট যথাসময়ে দেওয়া হয় না। অনেকক্ষেত্রে চার্জশীটে ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত দুর্বলতার কারণে ভুক্তভোগীরা ন্যায় বিচার বঞ্চিত হন। অন্যান্য দেশের মতো ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন অপরাধে আমাদের দেশেও শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ সাজা ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন সূত্রে বলা যায়, চীনে ধর্ষকের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাত দিনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সৌদি আরবে ধর্ষণে জড়িত থাকলে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ। তবে তার আগে দোষীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে দেওয়া হয়। ফ্রান্সে ধর্ষণের শাস্তি ১৫ বছরের কারাদণ্ড। তবে ঘটনায় ক্ষতি ও নৃশংসতার বিচারে তা ৩০ বছর পর্যন্ত বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে। আফগানিস্তানে আদালত রায় দেওয়ার চার দিনের মধ্যে অভিযুক্তকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয় কিংবা ফাঁসি দেওয়া হয়। উত্তর কোরিয়ায় ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে অপরাধীকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। ইরানে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ফাঁসি অথবা প্রকাশ্যে পাথর মেরে কার্যকর করা হয়। মিসরে এখনো অনেক অপরাধে মধ্যযুগীয় শাস্তির প্রথা থাকলেও ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি। ইসরায়েলে দোষ প্রমাণ হলে ১৬ বছরের কারাদণ্ড। সে দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা কিছুটা বর্ধিত। অন্য যৌন নির্যাতনও এর অন্তর্ভুক্ত। রাশিয়ায় ধর্ষকের তিন থেকে ছয় বছরের কারাদণ্ড। তবে পরিস্থিতির বিচারে তা ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। যদি ধর্ষকের আচরণ অত্যন্ত নৃশংস হয়ে থাকে, তবে ২০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে স্টেট ও ফেডারেল আইন অনুযায়ী ধর্ষণের বিচার ভিন্ন। ফেডারেল আইন অনুযায়ী দোষীর সাজা কয়েক বছরের কারাদণ্ড থেকে যাবজ্জীবনও হতে পারে। মঙ্গোলিয়ায় ধর্ষিতার পরিবারের হাত দিয়ে ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। নরওয়েতে সম্মতি ছাড়া যে কোনো যৌনতা ধর্ষণের মধ্যে পড়ে। নৃশংসতা অনুযায়ী দোষীর ৩ থেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়।
মান্যবর প্রধান বিচারপতির বক্তব্য অনুসারে, ‘আমরা সমস্যার মূলে যদি হাত না দেই, যত অনিয়মের কথা বলি কোনো অনিয়ম কোর্ট থেকে দূর হবে না। আগে মূলে আঘাত করতে হবে। মূলে আঘাত করলে অনিয়ম দূর হবে। তার আগে অনিয়ম দূর হবে না।’ এই অমিয় সত্যটিকে শতভাগ ধারণ করে আমাদের সমস্যা ও কারণ উদ্ঘাটন নিগূঢ় অনুসন্ধান ও গবেষণার প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ঘোষিত বজ্রকঠিন অঙ্গীকারের যথাযথ বাস্ত্তবায়নে তাঁর হাতকে শক্তিশালী করার জন্য দেশের সকল জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হবে এবং এই অপসংস্কৃতি রুখে দিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের চূড়ান্ত শাস্তিস্বরূপ অতিসম্প্রতি প্রণিত মৃত্যুদণ্ডাদেশ আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে অনতিবিলম্বে এর ঘৃণ্য পুনরাবৃত্তি রোধ করতেই হবে। স্বল্প পরিসরে এই নিবন্ধের শেষে কবি শেখ ফজলল করিমের ‘স্বর্গনরক’ কবিতার উপযোগী পংক্তি প্রমুদিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি – ‘রিপুর তাড়নে যখন মোদের বিবেক পায় গো লয়,/আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনই পুড়িতে হয়।’ প্রযোজ্য রিপুর তাড়নায় বিকৃত মানসিকতার নরপশুতুল্য দানবদের চিরতরে পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে বিতাড়িত করার সামগ্রিক আইনি পন্থা অবলম্বন করে বিশ্বকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য নান্দনিক-মাঙ্গলিক-নিরাপদ বাসযোগ্য করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়