দোয়া বা প্রার্থনা মহান আল্লাহর সেরা ইবাদত। নবীজি (সা.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে দোয়া বা প্রার্থনা করা বৈধ নয়। কেননা দোয়ার মাধ্যমেই আল্লাহর কাছে নিজেদের মুখাপেক্ষীতা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। এ কারণেই নবীজি (সা.) বলেছেন দোয়াই হলো ইবাদাত। নবীজি (সা.) মহান আল্লাহর কাছেই তাঁর সব আকুতি জানাতেন। যে কোনো বিষয়ে দোয়া, বিনয়, অভাব, চাহিদা শুধু আল্লাহর কাছেই প্রকাশ করতেন। তিনি আল্লাহর কাছে সব কথা সব বিষয় জানাতে পছন্দ করতেন। তাইতো তিনি বলেছেন দোয়া ব্যতীত অন্য কোনো কিছুই (মানুষের) ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর ভালোবাসা পেতে হলে রাসুল (সা.) এর অনুসরণের বিকল্প নেই। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন বলো যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তাহলে আমার অনুসরণ করো আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমার পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (আল ইমরান : আয়াত : ৩১) অতএব আমরা যদি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চাই আমাদের অবশ্যই রাসুল (সা.) এর অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহর রাসূল (সা.) পুরো জীবন উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য অনুসরণীয়–অনুকরণীয়। নবুয়ত লাভের পর থেকে তিনি তাঁর জীবনের পুরোটা সময় ব্যয় করেছেন উম্মতের জন্য। তাদের শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে দুনিয়া আখেরাত উভয় জগতে একজন মানুষ সফল হতে পারবেন। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আল্লাহর রাসুল (সা.) দোয়া করতেন উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নী আউজুবিকা মিনাল আরবাই মিন ইলমিন লা ইয়ানফাউ মিন কলবিন লা ইয়াখশাউ ওয়া মিন নাফসিন লা তাশবাউ ওয়া মিন দুআয়িন লা ইউসমাউ। অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই চার বিষয় থেকে অনুপকারী জ্ঞান থেকে, ভীতিহীন অন্তর থেকে, অতৃপ্ত প্রবৃত্তি থেকে এবং এমন দোয়া থেকে যা শোনা হয় না।
অনুপকারী জ্ঞান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়েছেন : এ দোয়াটিতে আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রথমেই অনুপকারী জ্ঞান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়েছেন। যে জ্ঞান মানুষকে আল্লাহর ব্যাপারে সচেতন করে আল্লাহভীরু ও বিনয়ী বানায় খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকতে এবং ভালো কাজ করতে সাহায্য করে তা উপকারী জ্ঞান। যে জ্ঞান মানুষকে সুপথের সন্ধান দিতে পারে না নেক বানাতে পারে না উল্টো অহংকারী বানায় তা অনুপকারী জ্ঞান। (সুরা মুজাদালা : ১১) আর অনুপকারী জ্ঞান গুনাহের দায় ও শাস্তি বৃদ্ধি করে। অজ্ঞ ব্যক্তির অনেক গুনাহ তার অজ্ঞতার কারণে আল্লাহতাআলা হয়ত মাফ করে দিতে পারেন কিন্তু জেনে বুঝে যে গুনাহ করে তার ক্ষমা পাওয়া কঠিন।
ভীতিহীন অন্তর থেকে : এরপর নবিজি (সা.)-আশ্রয় চেয়েছেন ভীতিহীন অন্তর থেকে। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় নেই এমন অন্তর থেকে। একজন মুমিনের অন্তরে আল্লাহর রহমতের আশা থাকা যেমন অপরিহার্য আল্লাহর ভয় থাকাও অপরিহার্য। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ একইসাথে তার রহমত ও ক্ষমার জন্য আশাবাদী হতে বলেছেন আবার তাকে ভয় করারও নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনে আল্লাহ তার উত্তম বান্দাদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন তারা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করত তারা আমাকে ডাকত আশা ও ভীতির সাথে এবং তারা ছিল আমার নিকট বিনীত। (সুরা আম্বিয়া : ৯০) আরেক আয়াতে আল্লাহতাআলা বলেন আমাকে ভয় কর যদি তোমরা মুমিন হও। (সুরা আল ইমরান : ১৭৫)
এমন দোয়া থেকে যা শোনা হয় না : এরপর নবিজি (সা.) এমন দোয়া থেকেও আল্লাহতাআলার আশ্রয় চেয়েছেন যে দোয়া শোনা হয় না। মুমিন আল্লাহতাআলার কাছে যে কল্যাণকর দোয়া করে তা সাধারণত ব্যর্থ হয় না। দোয়ার বদলা আল্লাহতাআলা অবশ্যই দান করেন। তবে বিভিন্ন সময় দোয়ার প্রতিদান বিভিন্ন রকম হয়। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন যখন কোনো মুমিন ব্যক্তি এমন দোয়া করে যে দোয়াতে কোনো পাপ ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় নেই তাহলে আল্লাহ তিন পদ্ধতির কোনো এক পদ্ধতিতে তার দোয়া কবুল করে নেন হয়ত যে দোয়া সে করেছে তা ওইভাবেই কবুল করেন তার দোয়ার প্রতিদান আখেরাতের জন্য সংরক্ষণ করেন অথবা এ দোয়ার মাধ্যমে তার ওপর আগত কোনো বিপদ তিনি দূর করে দেন। এ কথা শুনে সাহাবিরা বললেন, আমরা তাহলে অধিক পরিমাণে দোয়া করতে থাকবো। আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, তোমরা যত দোয়াই করবে আল্লাহ তার চেয়ে অনেক বেশি কবুল করতে পারেন। তবে জুলুম, হারাম উপার্জন ইত্যাদি কিছু গুনাহের কারণে দোয়া বিফল হতে পারে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন যখন তোমাদের কেউ তাশাহহুদে উপনীতে হয় তখন যেন সে চারটি বিষয় থেকে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করে। সে বলবে হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে আশ্রয় কামনা করছি জাহান্নামের শাস্তি থেকে, কবরের শাস্তি থেকে, জীবন ও মৃত্যুর ফেতনা থেকে এবং দাজ্জালের ফেতনার ভয়াবহতা থেকে।
কবরের শাস্তি : হাদিসে সর্বপ্রথম কবরের শাস্তি থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। কেননা কবরই হলো পরকালের প্রথম স্তর। যে ব্যক্তি কবরের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে, পরকালের পরবর্তী স্তরগুলো তার জন্য সহজ হবে। আর কবরে শাস্তি পাওয়ার অর্থ হলো ব্যক্তির জন্য সামনে হয়তো আরো কঠিন সময় আসছে।
জাহান্নামের শাস্তি : রাসুলুল্লাহ (সা.) জাহান্নামের শাস্তি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা করেছেন। জাহান্নাম হলো পরকালের যে শাস্তি মহান আল্লাহ তার অবাধ্য ও পাপী বান্দাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। পরকালের এই শাস্তির ভয়াবহতা মানুষের কল্পনার অতীত। তাই পূর্ববর্তী সব বুজুর্গ, সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এমনকি নবী–রাসুলগণ (আ.) পর্যন্ত জাহান্নামের শাস্তি থেকে আল্লাহর কাছে মুক্তি কামনা করেছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে সে সেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটাই মানবজীবনের চূড়ান্ত সাফল্য।
জীবন–মৃত্যুর ফেতনা : এর দ্বারা উদ্দেশ্য পার্থিব জীবনের বিপদ–আপদ ও পরীক্ষাগুলো। এমন বিষয় যা মানুষকে ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যেমন কুফর, শিরক, প্রবৃত্তিপূজা, পাপাচার, অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ইত্যাদি।
দাজ্জালের ফেতনা : কিয়ামতের পূর্বে দাজ্জাল পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করবে এবং পৃথিবী এক ভয়াবহ ফেতনায় আক্রান্ত হবে। তার কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঈমানহারা হবে। দাজ্জালের ফেতনা কিয়ামতের বড় বড় ফেতনাগুলোর অন্যতম। দাজ্জাল অস্বাভাবিক ক্ষমতার অধিকারী হবে। যেমন মৃতকে জীবিত করা, সবুজ ভূমিকে বিরান ভূমিতে পরিণত করা, পৃথিবীর ধনভান্ডার উন্মুক্ত করা ইত্যাদি। আল্লাহর রাসুল (সা.) এসব বিষয় থেকে শুধু অন্যকে আশ্রয় কামনা করতে বলেননি বরং নিজেও আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা করেছেন।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত সব সময় মহান আল্লাহর কাছে নিজেদের চাওয়াগুলো তুলে ধরা। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। মুমিনের প্রতিটি চাওয়া–পাওয়াই হোক ইবাদত। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর ভালোবাসা পেতে হলে রাসুল (সা.) এর অনুসরণের বিকল্প নেই। আমরা যদি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চাই আমাদের অবশ্যই রাসুল (সা.) এর অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে নবীজির (সা.) অনুসরণ ও অনুকরণে ছোট থেকে বড় সব বিষয়ে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করার মাধ্যমে ইবাদত–বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট












