জাতিসংঘের ভাষ্য মতে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর নাম হলো ‘রোহিঙ্গা’। এ জাতির শিশুরাই এ জগৎ সর্বাধিক অধিকার বঞ্চিত শিশুর অন্যতম উদাহরণ। ‘রোহিঙ্গা’ হচ্ছে একটি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক মুসলিম জনগোষ্ঠী। তারা দীর্ঘদিন ধরে আরাকানের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ৮ম শতক হতে মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে বসবাসের সত্যতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণীত। তারা ৭ম শতক হতে মিয়ানমারে বসবাসকারী নাগরিক এবং মিয়ানমারের সমাজ, সাংস্কৃতি ও রাজনীতির অভিচ্ছেদ্য অংশ। খৃষ্টীয় ৮ শতাব্দীতে চন্দ্র বংশীয় রাজারা আরাকান শাসন করতেন। ঐ সময় রাজা মহৎ উঙ্গ চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮–৮১০) কয়েকটি আরব বাণিজ্য তরী রামব্রী দ্বীপের কাছে বিধ্বস্ত হয়। জাহাজের আরোহীগণ ‘রহম’ ‘রহম’ বলে চিৎকার করে সহায়তার জন্য। স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে আরাকান রাজার নিকট নিয়ে যায়। তাদের উন্নত আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে রাজা তাদের আরাকানে বসতি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করে। আরবী ভাষায় অনভিজ্ঞ স্থানীয় লোকজন তাদের ‘রহম’ গোত্রের লোক মনে করে ‘রহম’ বলে ডাকা শুরু করে। ক্রমশ শব্দটি বিকৃত হয়ে রহম–রোয়াং–রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গা নাম ধারণ করে।
‘রোহিঙ্গা’ জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জাতিগত নিধনের শিকার। দীর্ঘকাল যাবৎ এ জাতি হত্যা, লুণ্ঠন, নিপীড়ন, নির্যাতন, বর্বরতার শিকার হয়ে স্বদেশ হতে বলপূর্বক বিতাড়িত হচ্ছে। প্রাণ ভয়ে স্বদেশ হতে পালিয়ে এ দেশে আশ্রয় নিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ১৯৪২ সালে জাপানকে সমর্থনের দায়ে ৫০ হাজর রোহিঙ্গা নিধন হয়। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকার ১৯৬২ (সামরিক অভিযান), ১৯৭৮ (অপারেশন কিং ড্রাগন), ১৯৯১ (অপারেশন পিয়েথাম), ২০১২ (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা), ২০১৬ (অপারেশন ক্লিয়ারেন্স) সহ বিবিধ অভিযান পরিচালনা করে। গত দশকে নিপীড়নের শিকার হয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। যার সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ শিশু। একজন মানব শিশু হিসেবে প্রত্যেক শিশুর আছে বেঁচে থাকার অধিকার। কিন্তু যে অবস্থায় বেঁচে থাকা দায়, এ ক্ষেত্রে একজন শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ কী আদৌ সম্ভব!
সর্বশেষ বলপূর্বক বাস্তুুচ্যুত মায়ানমার নাগরিক ২০১৭ সালে জীবন রক্ষার তাগিদে আশ্রয়ের জন্য দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মানবতাবদী মহান নেত্রী শেখ হাসিনা নির্যাতন, নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার বাস্তুচ্যুত ঐসব নাগরিকদের সাময়িক আশ্রয় প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে এ বিষয়ে ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ২২ দফা নির্দেশনা সম্বলিত পরিপত্র জারি করা হয় এ নির্দেশনায় সমাজসেবা অধিদপ্তরকে রোহিঙ্গা এতিম শিশুদের কুাক্তকরণ, রেজিস্টারভূক্ত ও তাদের কল্যাণে পরিকল্পনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এ প্রেক্ষিতে কক্সবাজারে ইউনিসেফ ও সমাজসেবা অধিদপ্তর যৌথভবে ‘রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে রাখাইন প্রদেশ হতে বিতাড়িত এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত ৩৯,৪৮১ এতিম ও ঝঁকিপূর্ণ শিশু কুাক্ত করে। কুাক্তকৃত প্রত্যেক শিশুর ঈধংব গধহধমবসবহঃ করা হয়। শিশুর ঝুঁকি বিবেচনায় রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষার জন্য বিবিধ উদ্যোগ (কেয়ার গিভার, অল্টারনেটিভ কেয়ার গিভার, ক্যাশ সাপোর্ট ও কেস রেফারেল) বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গ্রহণ করা হয়।
বাাংলাদেশ সরকার ও টঘঐঈজ তথ্য মতে ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ খ্রি. পর্যন্ত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিক হিসেবে এ দেশে নিবন্ধিত আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা ৯,৫৪,৭০৭ জন। বাস্তুচ্যুত পরিবার সংখ্যা ১,৯৭,৩০৩ টি। আাশ্রয় প্রার্থীর মধ্যে ৫২ শতাংশই শিশু। নিরাপত্তাহীনতার শিকার দেশে আশ্রয় প্রার্থী শিশুদের অনেকেই পিতৃহীন, মাতৃহীন, পিতা–মাতাহীন, পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন কিংবা পরিত্যক্ত। তাছাড়া প্রতিদিন গড়ে ৯৫ জন শিশু রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মগ্রহণ করছে। রোহিঙ্গা শিশুরা জাতিগত বর্বরতার শিকার। মাতুভূমি হতে বিতাড়িত এবং অধিকার বঞ্চিত। রাষ্ট্র কর্তৃক এসব শিশুদের অধিকার হনন করা হয়েছে। ভাগ্যবিড়ম্বিত রাষ্ট্রহীন এসব শিশুদের আইনগত অধিকার দাবীর কোনো ক্ষেত্র নেই। রোহিঙ্গা শিশুরা খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, বিনোদন, ক্রীড়া–সাংস্কৃতিক চর্চা, পারিবারিক পরিবেশ, পিতৃ–মাতৃ স্নেহ প্রভৃতি হতে বঞ্চিত।
এ বিশ্বে জন্ম গ্রহণকারী কোনো শিশু শুধু কোনো দেশের নাগরিক নয় বরং বিশ্ব নাগরিক। এ মূল্যবোধকে ধারণ করে ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ–১৯৮৯’ গৃহীত হয়। এ সনদ শিশু অধিকার ও মানবাধিকারের একটি অন্যতম দলিল। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের ২৬ জানুয়ারি এ সনদে স্বাক্ষর করে। এ স্বাক্ষরের মাধ্যমে সরকার শিশুদের অধিকার সংরক্ষণে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। অপরদিকে এ সনদ শিশু সুরক্ষার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট সরকারের দায়বদ্ধতার দলিল। শিশু অধিকার সনদের মূলনীতি হচ্ছে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ, বৈষম্যহীনতা, জীবনধারণ–জীবন রক্ষার অধিকার ও শিশুর মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। বিশ্বের সকল প্রান্তের দুর্দশাগ্রস্ত শিশুদের সুরক্ষা, প্রত্যেক শিশুর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে শিশুর বিকাশ সুনিশ্চিত করা এ সনদের মূল কথা। এ আর্ন্তজাতিক সনদের প্রতি অংঙ্গীকারের কারণে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
মায়ানমার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতাত্তোর পদক্ষেপ প্রতি ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনন্য ভূমিকা আছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সুচির বাবা জেনারেল অং সানের অন্যতম রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন বার্মা মুসলিমলীগ সভাপতি আব্দুল রাজ্জাক। তিনি ছিলেন মিয়ানমার স্বাধীনতা পূর্ববর্তী জেনারেল অং সান মন্ত্রিসভার শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রী। ১৯৪৭ সালে জেনারেল অং সানের সঙ্গে খুন হওয়া ছয়জন মন্ত্রীর মধ্যে তিনিও একজন ছিল। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মিয়ানমারের জাতীয়তাবাদী আন্দেলনের অন্যতম কেন্দ্রভূমি ছিল রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৩৩ সালে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ জটঈঝঈ প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং জনাব এম এ রশিদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩৬ সালে তিনি উক্ত সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং অং সান সহ–সভাপতি নির্বাচিত হন। রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে রশিদ, অং সান ও উ নু ছিলেন তিন প্রাণের বন্ধু। এই নেতারাই ছিলেন বার্মার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণ পুরুষ। ১৯৪৭ সালে প্রণীত মিয়ানমার সংবিধানের অন্যতম খসড়াকারী ছিলেন রশিদ। তিনি স্বাধীন মিয়ানমারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী উ ন’র মন্ত্রীসভার শ্রমমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৩৫ টি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর মিয়ানমার সরকার স্বাধীনতা পরবর্তী রোহিঙ্গাদের একটি স্বতন্ত্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি প্রদানে বিড়ম্বনা করে। পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে উ নু সরকার ১৯৫৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের স্বদেশী হিসেবে ঘোষণা করে।
‘রোহিঙ্গা’ বর্তমান বিশ্বের একটি অন্যতম নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। এ রোহিঙ্গা শিশুরা জাতিগত সংঘাতের শিকার। যেকোনো সংঘাতময় পরিবেশ শিশুর বেঁচে থাকা ও বিকাশের জন্য চরম হুমকী। বিকাশবঞ্চিত শিশুরা কি কোন রাষ্ট্রের সম্পদ হতে পারে? রোহিঙ্গা শিশুরা আজ রাষ্ট্রহীন এবং অধিকার বঞ্চিত। এ শিশুরা আপন ভূমি হতে বিতাড়িত। বাস্তুচ্যুত এসব শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার দায় একক কোন জাতি গোষ্ঠীর নয়। বরং এর দায় সমগ্র বিশ্ববাসীর। বিশেষত যারা বর্তমান বিশ্বসমাজের নিয়ন্ত্রক ও পৃষ্ঠপোষক। সকল দেশে বৈষম্যহীন, নিপীড়নমুক্ত ও শিশুবান্ধব সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হোক। বন্ধ হোক জাতিগত সংঘাত। রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা শিশুর করুণ আর্তনাদ কী বন্ধ হবে! এ প্রশ্ন বিশ্ব মানবতাবাদীদের। শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের মানবিক ভূমিকাই হবে বিশ্ব শান্তির একমাত্র পথ। বিশ্ব নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গা শিশুর সুরক্ষা সুনিশ্চিত হোক।
লেখক : সহকারী পরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর, বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম।