রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কাদের স্বার্থে?

ড. মো. মোরশেদুল আলম

| রবিবার , ১১ জুন, ২০২৩ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

সকল প্রকার কূটনীতি ও জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া সেনাবাহিনী ইউক্রেনে অনুপ্রবেশ করেছিল। ইউক্রেন সীমান্তে ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্য সমাবেশ শুরু করার সময়ে রাশিয়া আমেরিকার নিকট ৮দফা নিরাপত্তার নিশ্চয়তার দাবি পেশ করেছিল। দাবিগুলো পূরণ না হলে ১৯৬২ সালের কিউবার মিসাইল সংকটের সামরিক প্রতিক্রিয়ার পরিস্থিতি হতে পারে বালে রাশিয়া জানিয়েছিল।

রাশিয়াইউক্রেন সমঝোতার যেটুকু সম্ভাবনা ছিল, তা ভেস্তে যায় জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলজের ওয়াশিংটন সফরের পর। ওয়াশিংটনে যাওয়ার পূর্বে তিনি সমঝোতার পক্ষে অনেক সাফাই গেয়েছিলেন। ইউক্রেনে মরণাস্ত্র পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানির জন্য বাল্টিক সাগরের মধ্য দিয়ে নর্ড স্ট্রিম নামে পরিচিত যে পাপলাইন তৈরি করা হয়েছে সে বিষয়েও কিছু বলেন নি। কিন্তু ওয়াশিংটন থেকে ফিরে এসেই তিনি নর্ড স্ট্রিম ২এর অনুমোদন অনির্দিষ্টকালে জন্য বন্ধ করে দেন। ইউক্রেনে মরণাস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা দেন। প্রথম দিকের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করলে অনুধাবন করা যাবে, রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধটা এড়াতে ফ্রান্স এবং জার্মানির চেষ্টা ছিল। আমেরিকাই যুদ্ধটা চেয়েছিল এবং সেই সাথে সুর মিলিয়েছিল যুক্তরাজ্য। যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাস্ত করতে পারলে বিশ্বব্যবস্থার ওপর আমেরিকার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আরও জোরালো হবে এবং সেই সাথে চীন ও ভারতের অগ্রগতি হ্রাস পাবে।

রাশিয়া ইউক্রেনে ঢুকেছে ইউক্রেনের দুটি প্রজাতন্ত্র দোনেটৎস্ক ও লুহানস্কের আমন্ত্রণে। এ দুটি প্রজাতন্ত্র স্বাধীনতা ঘোষণা করলে রুশ সংসদ তার স্বীকৃতি প্রদান করে। কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারলে দোনেটৎস্ক ও লুহানস্কের জন্য স্বীকৃতি আদায় করা এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখা যাবে না। রাশিয়ার জয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারে দেশপ্রেমিক ইউক্রেনিয়ান সৈন্যবাহিনী আর যোদ্ধারা। তারা রাশিয়ার কিয়েভ দখল যত পেছাতে পারবে, রাশিয়ার জয়ের আশা ক্ষীণ হয়ে আসবে। তবে ইউক্রেন এক্ষেত্রে কতটুকু সফল হতে পারে তাও দেখার বিষয়। তবে ইউক্রেন জয় করে তা পরিচালনা করা কিন্তু রাশিয়ার উদ্দেশ্য নয়। এই যুদ্ধে রাশিয়া জয়ী হতে পারলে ইউক্রেনের সাথে চুক্তি করে দেশটিকে ন্যাটোতে যোগ দেয়া থেকে বিরত রেখে এবং দোনেটৎস্ক ও লুহানস্কের স্বাধীনতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য করে ফিরে যেতে পারে। রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের জন্য অবশ্য তিনটি শর্ত দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে: ) ইউক্রেন ন্যাটো জোটের সাথে যাবে না তা সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। ২) ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে মেনে নিতে হবে। এবং ৩) ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল দোনেটৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীনতা দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউক্রেন বাস্তবতার আলোক ও দেশের নিরাপত্তা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের কথা বিবেচনায় রেখে শর্তগুলোর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রাশিয়ার সাথে আলোচনায় বসতে পারে। রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়ার কারণে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। রাশিয়া আমেরিকার সঙ্গে তাদের পারমাণবিক চুক্তি (স্টার্ট চুক্তি) স্থগিত করেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, নিউ স্টার্ট চুক্তি স্থগিত হলে পারমাণবিক অস্ত্রের বৈশ্বিক বৃদ্ধির আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলবে। রাশিয়াইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ হলেও মূলত এটি দুটি শক্তি বলয়ের সংঘর্ষকে প্রকাশ করছে। একটি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘আধিপত্য’ এবং অন্যটি হল রাশিয়ার ‘নব্য সম্প্রসারণ নীতি’। এ দুটি বৃহৎ শক্তি মূলত বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা থেকেই বিশ্ববাসী রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কৌশলও রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে রাজনৈতিক, অর্থনেতিক এবং সামরিক সহযোগিতা দিচ্ছে। এই যুদ্ধে বিশ্ব আবারো প্রকারান্তরে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। আবার রাশিয়ার পক্ষের শক্তিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এসব অবরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক বিভক্তির পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবেও বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনেস্কি ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি ইউক্রেন সফর করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ২০ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন সফর করেন। বাইডেনের ইউক্রেন সফরের পরপরই ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই রাশিয়া সফর করেন। তিনি রাশিয়ার নেতাদের সাথে বৈঠক করেন এবং এ সফরের পর তিনি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ১২ দফা শান্তি পরিকল্পনা পেশ করেন। এসব সফরের পরপরই সৌদি পররাষ্ট্র্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান ২৬ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন সফর করেন। তিনি এ সময় ইউক্রেনকে ৪০ কোটি ডলারের সহায়তার কথা ঘোষণা করেন। ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার পর কোনো সৌদি মন্ত্রীর এটিই প্রথম ইউক্রেন সফর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ২০ মার্চ তিন দিনের সফরে মস্কোতে যান চীনের প্রেসডিেন্ট শি জিনপিং। মস্কো যাওয়ার এক মাস আগে যুদ্ধ বন্ধে ১২ দফার যে শান্তি প্রস্তাব চীন দেয়; সেখানে জরুরিভিত্তিতে যুদ্ধবিরতি এবং শান্তি আলোচনার কথা বলেছে বেইজিং। এ বৈঠকে পুতিন বলেছেন, চীন যে শান্তি প্রস্তাব দিয়েছে সেটি নিয়ে তারা আলোচনা করবেন। তবে চীন এখনই যুদ্ধ বন্ধ করার যে প্রস্তাব করছে, যুক্তরাষ্ট্র সেটির কিন্তু বিরোধিতা করছে। শি জিনপিং মস্কো যাওয়ার পর পরই রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তৎপরতা আরও বাড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন দাবি করেছেন চীন যুদ্ধবিরতির চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এতে রুশ সেনাদের ইউক্রেন ছাড়ার বিষয়টির উল্লেখ নেই। যদি সেনা প্রত্যাহার ছাড়া রাশিয়াইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়রাশিয়া এ সময়টা ব্যবহার করে নিজ সৈন্যদের আরও সংগঠিত করার চেষ্টা করবে এবং পরবর্তীসময়ে সুযোগ বুঝে হামলা চালাবে। তিনি আরও বলেন, সেনা প্রত্যাহার ছাড়া এখন যুদ্ধবিরতির বিষয়টি রাশিয়ার বিজয়কে সমর্থন জানানোর সামিল হবে। এটি স্বাধীন প্রতিবেশি দেশের ভূখণ্ড জোরপূর্বক দখল করার বিষয়টিকে স্বীকৃতি দিবে। তিনি বলেন, শান্তি প্রস্তাবের মূল বিষয় হতে হবে ‘ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রাখা।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কূটনীতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক জন কিরবি বলেছেন, এ মুহূর্তে যুদ্ধবিরতির মানে হলরাশিয়ার অর্জনগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া, সেনাদের প্রশিক্ষণ ও রসদ পাঠানোর জন্য পুতিনকে সময় দেয়া, যেন সময় সুযোগ বুঝে পুতিন আবারও হামলা শুরু করতে পারেন। সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে তিনি বলেছেন, চীন এখন যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দিলে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করবে।

এই যুদ্ধ এখন আর ইউক্রেনরাশিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন বহুপক্ষীয় যুদ্ধের রূপ ধারণ করেছে এবং পরাশক্তিগুলোও যুদ্ধের অংশে পরিণত হয়েছে। রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া ও চীন কৌশলগত কারণে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। পশ্চিমা শক্তি দেশ দুটির অভিন্ন শত্রু। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এসে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার সীমান্তের কাছে তাদের সদস্য যেভাবে বৃদ্ধি করে আসছে, তা রাশির জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের এমন আক্রমণাত্মক নীতির ফলে ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত বিষয় তাই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনে জয়ী হতে পারলে চীন, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরান ও ভারতের সমর্থন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনা থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়াসহ সমগ্র পৃথিবীকে মুক্ত করে নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হবে।

লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলীলা নাগ : স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী নারী
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে