দুহাজার উনিশের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকের কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুদিনের সফর শেষে ফিরে আসতে গিয়ে মনটা কেমন কেমন করে উঠল! বড় মায়ায় ভরা বিশ্ববিদ্যালয়। মায়া শহরময়। আজও সবুজ। সারি-সারি আমবাগান বৈশাখ জ্যৈষ্ঠব্যাপী ফলদান শেষে ঠায় দাঁড়িয়ে ছায়াবৃক্ষ হয়ে। পদ্মপুকুর, পানাপুকুর, জোড়া দীঘি- জলাশয় উপচে পড়ছে শরতের মাঝামাঝিতে। অন্য শহরগুলোর মতো কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে না দিনরাত। ভারী ভারী কারখানা নেই, নেই তাই দানব আকৃতির ভারী যানবাহন। যানজটে নাকাল হবার আশংকা নেই। যখন তখন গাড়ির চাকায় পিস্ট হয়ে যাবার ভয়ও নেই খুব একটা। শাহ মখদুমের পুণ্যভুমিতে ঘরের দুয়ারে খিল দিয়ে রাখতে হয়না দিনরাত। বাঙালি আতিথেয়তার ঐতিহ্য আজও বর্তমান পূর্ণমাত্রায়। লোকপ্রশাসন বিভাগের সভাপতি বন্ধুপ্রতিম অধ্যাপক ড. সাজেদা আকতারের উষ্ণ আতিথেয়তা ও সার্বক্ষণিক সঙ্গ ভোলার নয়।
মতিহার থানার কাজলা’র মুখেই বিশ্ববিদ্যালয়; জোহা স্যারের পাঠশালা। সেই জোহা স্যার, শহীদ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা, যিনি ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন ঊনসত্তরের উত্তাল দিনে। সেদিন থেকে নতুন প্রাণ আর শক্তি পায় বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম। তারপর তো সব ইতিহাস। সেই ইতিহাসই কথা কয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনায় কোনায়, প্রতিটি ধুলিকনায়। জোহা স্যার ঘুমিয়ে আছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অর্ধশতক ধরে। কালের সাক্ষী হয়ে আছে অক্ষত চিরঞ্জীব তাঁর সেই উক্তি- ‘আহত ছাত্রদের পবিত্র রক্তের স্পর্শে আজ আমি উজ্জীবিত… কোন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে সে গুলি আমার বুকে লাগবে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন বিপ্লবী সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি (অস্থায়ী) সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে। সেই ভবনের সামনেই বিশাল সবুজ গালিচায় শ্বেত পাথরের সমাধিতে শুয়ে জোহা স্যার যেন অতন্দ্র প্রহরী হয়ে চোখে চোখে রাখছেন একুশ শতকের ছেলেমেয়েদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জেগে থাকে মধ্যরাত অব্দি। কাজে নিমগ্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থী। কবিতা, গানবাজনা, আড্ডাবাজি সব চলে সমানতালে। গ্রন্থাগার, আমবাগান, খাবারের দোকান, শান বাঁধানো পুকুরঘাট সরগরম দিবারাত্র। হীরক জয়ন্তী উদযাপিত হয়েছিল অনেকদিন আগে। সুবর্ণজয়ন্তী মিনারটি আজও দাঁড়িয়ে আছে স্থাপত্যের অনুপম নিদর্শন হয়ে। সদ্য নির্মিত ‘সাবাস বাংলাদেশ’ মনে করিয়ে দেয় অপরাজেয় বাংলার কথা। শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ সিনেট ভবনের সামনে বিশালাকৃতির খোলা বই; বলছে বিজ্ঞান, দর্শন আর ইতিহাসের কথা।
জোহা স্যারের সমাধি থেকে একটু পুব দিকে দু’পা এগিয়ে গেলেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি উৎসর্গকৃত এই সৌধের উদ্বোধন হয় ১৩৭৯ বঙ্গাব্দের ২৬ বৈশাখে, আর উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তখন তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ১৪২৬বঙ্গাব্দের দশ’ই আশ্বিনের বৃষ্টিভেজা সেই রাতে সড়কবাতির অল্প আলোয় দেখা সেই উদ্বোধনী ফলকের ছবি আমার আনকোরা মুঠোফোনে পরিষ্কারভাবে উঠে আসেনি। তবে ছবি তুলতে দিয়ে বুকের কাঁপন টের পেয়েছিলাম। ঠিক এখানটাতেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি; আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক, বাংলাদেশ নামের অকুতোভয় রাষ্ট্রটির জন্মের পরপর।
এই ফলকের বিপরীতদিকে আরেকটি ফলক, যার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয় বছর তিনেক পর, ১৩৮২ বঙ্গাব্দের নয়’ই বৈশাখ। উদ্বোধন করেন একাত্তরের বিপ্লবী সরকারের আরেক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী। এই ফলক দুটোর দিকে চোখ পড়লে বাঙালিমাত্রই মন ভিজে উঠবে। স্মারকগুলো একালের ছেলেমেয়েদের বুকে মমতা জাগাবে দেশের প্রতি, একাত্তরের প্রতি, আমাদের গৌরবময় মুক্তিসংগ্রামের প্রতি। শুধু কি তাই? বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব সীমান্তে এক গণকবরে ঘুমিয়ে আছে নাম না জানা অগুনতি মৃত্যুহীন প্রাণ। সেই বধ্যভূমিতে নির্মিত স্মৃতিসৌধ বলে দেয় আরও কতও না-বলা কথা!
স্বাধীনতা স্মারক আরও আছে, ছড়িয়েছিটিয়ে- বিশ্ববিদ্যালয়ের এখানে সেখানে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ ও জন-ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র, ঢাকা’র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘জন-ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গিতে সংস্কৃতি, শান্তি, ও শিক্ষা’ (International Conference: Culture, Peace and Education From the Perspective of People’s History) সংক্রান্ত কয়েকশ গবেষণাপত্র নিয়ে তিন দিনের এক মহাসম্মেলনের ধকলের সঙ্গে আশ্বিনের বৃষ্টির তোড়ে পুরো চরাচর চোখ মেলে দেখার সুযোগ হয়নি। ছেলেবেলায় শোনা আঞ্জুমানারা বেগমের ‘রাজা নেই শাহী নেই রাজশাহী নাম, হাতিঘোড়া কিছু নেই আছে শুধু আম’ গানটা ভাজছিলাম মনে মনে, যদিও আমের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ মেলেনি এ-যাত্রায়। আবার আসব ফিরে, শীঘ্রই- এই বাসনা মনে নিয়েই বিদায় জানাই রাজশাহীকে এবারের মতো।
উড়োজাহাজ থেকে দেখা পদ্মার বিশালতা দেখে মনে পড়ে যায় কয়েক মুহূর্তেও জন্য দেখা রাতের পদ্মার মোহময় সেই রূপ। পদ্মা জড়িয়ে আছে পুরো শহরটাকে পরম আদরে। শরতেও যেন শ্রাবণের ধারা। পদ্মায় তাই ভরা যৌবন। বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে নানা রঙের নিয়নবাতি। পদ্মার টলটলে পানিতে রহস্যময় আলোর খেলা। সাদা আলোটাকে দেখে হঠাৎ মনে পড়ে যায় ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ’- ছেলেবেলায় পড়া সেই কাজলা দিদি’র কথা। এ-তো গেল নাগরিক সভ্যতার ছোঁয়ায় পদ্মার সান্ধকালীন চেহারা। বিদায়ের দিন ভোরসকালে গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে যে গেঁয়ো পদ্মার দেখা পেলাম কাশবনের ওপাড়ে, নজরুল বোধ হয় তাই দেখেই গেয়েছিলেন- পদ্মার ঢেউ রে-, মোর শুন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যা-রে…। ভাবছি, পদ্মা নদীর মাঝিরা সব গেল কোথায়? কুবের মাঝির সঙ্গে সবাই তো আর ময়না দ্বীপে পাড়ি জমায়নি। জেলেপল্লীটাই বা কোনদিকে, যে পল্লীতে ঈশ্বর কখনও পায়ের ধুলো দেননা। আজও এখানে ঘাট আছে। সে ঘাটে কেউ আর বাঁশি বাজায়না। ছেলের দল মেতেছে ক্রিকেট আর ফুটবলে। ছোট জালে পোনা মাছ ধরছে কেউ কেউ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দেখছে উৎসুক হয়ে। কেউ নাইছে, কেউবা কাপড় ধুইছে। বউঝিরা গালগল্প করছে শহর রক্ষা বাঁধের আশেপাশে। নাগরিক ব্যস্ততার তোড়জোড় নেই এ ঘাটে।
তবে ফেরার পথে এক বাড়িতে রান্নার তোড়জোড় চোখে পড়ে; বাড়ির কোন বাসিন্দার মৃত্যুপরবর্তী আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন চলছে মহাসমরোহে। নিশ্চয় অনেক মানুষ খেতে আসবে। একটু এগিয়ে গেলে বেওয়া’র দল, হাত পেতে চলেছে এ-বাড়ি ও-বাড়ি। এই বাংলার নিত্য অভাগী ওরা। সব শহরে, নগরে, গাঁও-গেরামে আছে ওরা। গায়ের কাপড় একই রকম; ছেঁড়া, নোংরা। অভাব ওদের জীবনসঙ্গী। ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ধারণ করে চলেছে ওরাও। তবে ওদের দিন বদলায় না। স্বাধীনতা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিক্ষার বাণী ওদের কানে যায় না। শান্তির সম্মেলনে ওদের কথাও কেউ বলে না।
নতুন দিনের গবেষক, নীতি নির্ধারকরা বলবে ওদের কথা- সেই ভরসা আজও হারিয়ে যায়নি। জোহা স্যারের পাঠশালা থেকেই হয়তো উঠবে আওয়াজ। সেই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়বে দিকে দিকে। সুর মেলাবে পূর্ব পশ্চিম আর দক্ষিণের সোনার মানুষেরা। আসল মানুষ – যারা মাথা উঁচু করে বাঁচবে, শিরদাঁড়া সোজা রাখবে, অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াবে না, প্রকৃতির আশীর্বাদ ও ইতিহাসের চিহ্নকে লালন করবে অনেক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায়। স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তিতে বিশ্ব আবারও অবাক হয়ে দেখবে আমাদের প্রাণের বাংলাদেশকে।
শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়