বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সমাজ সেবক, অনলবর্ষী বক্তা, চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র নেতা, বক্সির হাট বদরপাতি এলাকার কৃতীসন্তান মরহুম মোহাম্মদ সেলিম উল্লাহ ভাইকে খুব মনে পড়ে। গত ১০ আগস্ট তাঁর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী নীরবে নিভৃতে চলে গেলো। ২০২১ সালের ১০ আগস্ট বৈশ্বিক মহামারী করোনা আক্রান্ত হয়ে মহান প্রভু মালিক রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দিয়ে ৭৭ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী মিসেস সাজেদা বেগম, এক পুত্র, তিন কন্যা, ছয় ভাই, পাঁচ বোন ও অগণিত আত্মীয় স্বজন গুণগ্রাহী রেখে যান।
তাঁর ছোট ভাই মোহাম্মদ উল্ল্যাহর সাথে বন্ধুত্ব ও হাবীবুল্ল্যাহ আমাদের একই স্কুলের ছাত্র ও আমার সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় প্রায়ই তাঁদের বদরপাতির বাসায় আমার আসা–যাওয়া ছিলো। তিনি আমাকে নিজের ছোট ভাই এর মতো স্নেহ করতেন এবং মৃত্যুর কিছু দিন আগেও ফোনে কুশলাদি জানতে চান এবং তাঁকে দেখতে যেতে বলেন। দুর্ভাগ্যবশত আমি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তাঁর সাথে দেখা করতে পারিনি।
তিনি ষাট দশকের শেষ দিক পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতিতে সম্মান শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে জাতীয় ফেডারেশনের এনএসএফ এর (প্রতিষ্ঠাকাল ২৫ ডিসেম্বর ১৯৫৭) কলেজ শাখার ইউএসএফের সভাপতি (১৯৬৫ থেকে ১৯৬৬) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে ছাত্র থাকাকালে (১৯৬৬ থেকে ৬৭) এন এস এফ– এর কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৪৩ এর ১২ জানুয়ারি ৪ নং বদরপাতি রোডে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কবির মিয়া ও মাতা আয়েশা খাতুনের জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ধারক হিসেবে আমৃত্যু ঐতিহ্য বহন করে গেছেন। তাঁর পূর্বপুরুষ হাজী সৈয়দ মোঃ হাশেম উল্লাহ আরব দেশ থেকে এখানে বসতি স্থাপন করেন। তাদের দৌহিত্র সৈয়দ মোঃ আফাজ উল্লাহর পুত্র হলেন কবির মিয়া সলিমুল্লাহর পিতা এবং মাতৃসূত্রে তাঁর নানা হাজী মতিউর রহমানের পিতা হাজী আমির হোসেন বাকলিয়া মৌজার অন্যতম জমিদার দানবীরও ছিলেন। তিনি তাঁর বিপুল সম্পত্তি ‘হাজী আমির হোসেন সওদাগর ওয়াকফ স্টেট’ নামে ওয়াকফ করে যান।
মোহাম্মদ সলিমুল্লাহরা ছয় ভাই যথাক্রমে মোহাম্মদ নাসিরুল্লাহ, ফয়েজ উল্লাহ, মোঃ জাফর উল্লাহ, মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ, মোঃ হাবিবুল্লাহ ও পাঁচ বোন। মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ ৩২ নং আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কয়েকবার ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হন। চট্টগ্রামের ব্রিটিশ পাকিস্তান আমলের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দানবীর খ্যাত চান্দগাঁও নিবাসী হাজী চাঁদ মিয়া সওদাগরের কনিষ্ঠ পুত্র হাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম সওদাগর এর দ্বিতীয় কন্যা সাজেদা বেগমকে ১৯৭১ সালে সলিমুল্লাহ ভাই বিয়ে করেন। উল্লেখ্য তাঁর দাদা শ্বশুর হাজী চাঁদ মিয়া সওদাগর শুধু চট্টগ্রামের নয় মক্কা ও মদিনার মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। আমি ২০০১ প্রথম পবিত্র হজ পালন করতে গিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মুসাফির খানাগুলো দেখে এসেছি। হাজী চাঁদ মিয়া সওদাগর চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে বহু মসজিদ মাদ্রাসা এতিমখানা মুসাফির খানা ও রাস্তাঘাট প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আল্লাহ পাক তাকে বেহেস্ত নসিব করুক। জনাব সলিমুল্লাহ মৃত্যুকালে স্ত্রী এক ছেলে মুহাম্মদ ইসহাক মাসুদ, ৩ কন্যা রুম্মান আক্তার, ফয়েজুন নেসা বিনতে সেলিম ও রবিউন নেসা বিনতে সেলিম সহ বহু আত্মীয়–স্বজন রেখে যান। কর্মজীবনে ১৯৬৮ থেকে ৭০ পর্যন্ত চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দৈনিক আজাদীতে সাংবাদিকতা ও ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭৮‘এর প্রথম দিকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেনারেল মোঃ জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের আহবানে বিএনপিতে যোগ দেন এবং তাকে সভাপতি ও ষাট দশকের আরেক ছাত্র নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি কমিটি গঠন করা হয়। সেই আশি দশকে সলিমুল্লাহ তৎকালীন মহানগর এলাকার গিয়ে ছাত্র–যুব–শ্রমিক ও স্থানীয় জনগণকে সংগঠিত করে জেনারেল জিয়ার প্রবর্তিত জাতীয়তাবাদী শক্তির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করতে গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭৯ তে প্রার্থী ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক আরিফ মইনুদ্দিন ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিপুলে ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দলের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেন তা অতুলনীয়। কোন ধন সম্পদের মোহ সলিমুল্লাহকে টলাতে পারেনি।
তিনি আজ নেই, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর বর্ণাঢ্য স্মৃতিময় দীর্ঘ কর্মজীবন। আজীবন তিনি উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ইসলামী মূল্যবোধ জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক বাহক ছিলেন। কাজে কর্মে পরোপোকারীতা, নিঃস্বার্থপরতা, আত্মীয় স্বজন, এলাকাবাসী, পাড়া প্রতিবেশীসহ দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রতি তাঁর দরদী মনের পরিচয় পাওয়া যায় রাজনীতি করে অর্থশালী, বিত্তশালী হওয়া তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল না। অনেকের মতো রাজনীতি করে বিত্তশালী হতে পারতেন। বদরপাতির এজমালী পৈত্রিক বসতবাড়ি ছাড়া তাঁর আর কোন সম্পদ ও অঢেল অর্থ সম্পদ ছিল না। মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এসব নিঃস্বার্থবান দেশপ্রেমিক সহযোদ্ধাদের সাথে পেয়েছিলেন। আল্লাহ পাক এ নিঃস্বার্থ মানবদরদী মানুষটির নেক আমল কবুল করে তাঁকে মেহেরবানি করে জান্নাতুল ফেরদৌসের চিরস্থায়ী বাসিন্দা করে দিন, আমিন।
লেখক: আইনবিদ, গবেষক, কলামিস্ট, মানবাধিকার সুশাসন কর্মী।