হালের রাজনীতি পর্যবেক্ষণে বড়ই ব্যথিত হয়ে পাথরের সাথে মাথা মারতে ইচ্ছা করছে। যারা বেশি বেশি মানবাধিকারের কথা বলছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে তাদের হাতেই মানবাধিকার ধর্ষিত হচ্ছে। ইহুদীরা গাজায় হাসপাতালে বোমা বর্ষণ করছে আর বাংলাদেশে বিরোধীদল কর্তৃক রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স চত্বরে হাসপাতালে হামলা হচ্ছে। ওখানে দখলদারিত্ব ও কর্তৃত্বের লড়াই চলছে, আর এখানে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জিঘাংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। দুটোতে বড় বেশি তফাৎ নেই।এমনিতেই এদেশীয় রাজনীতিতে ইহুদীজম ঢুকে গেছে অনেক আগে, এটা এদেশের রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। নুরু সাহেব তো বিরক্তি ভরা মুখে ফোঁস ফোঁস করে বলে দিয়েছিলেন– ‘মোসাদের সাথে দেখা করেছি তো কী হয়েছে’? একজন রাজনীতিবিদ কতোটা অপরিপক্ক হলে এহেন কথা বলতে পারেন তা আমার বোধগম্যের বাইরে। নুরু দিয়েই শুরু নয় কিন্তু, এর আগেও পিন্টু–মিন্টু নান্টু বল্টু মোসাদের টাকায় পান–বিড়ি খেয়েছেন বলে শোনা যায়। যখন লাজ–নীতির চাকা পাংচার হয়ে যায় তখন সেই চাকা থেকে গোল গোল দুটো লোভাতুর চোখ এ ধরনের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ প্রসব করে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বে যখন মানুষ হত্যা করা হয়, তখন পশ্চিমারা ফিলিস্তিনে গণহত্যার নিন্দা না জানিয়ে ইসরায়েলে মাইক্রোস্কপ দিয়ে মানবতার সন্ধান করে থাকে। গতমাসের শেষের দিকে জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে বিএনপি অফিসে বসে জাইদুল ইসলাম মিয়ান আরেফিন ওরফে বিল্লাল মিয়া নামের এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সংবাদ সম্মেলন করে পশ্চিমা স্টাইলে ইংরেজির বুদ বুদ তোলে উপস্থিতিদের মিথ্যাচারে উষ্ণ করে পলায়ন কালে ডিবি কর্তৃক ধৃত হয়ে গড়গড় করে যেভাবে মাতৃভাষা বলতে আরম্ভ করল তাতে বিস্মিত হয়ে গোপাল ভাঁড়ের সে গল্পটা মনে পড়ে গেল। সে সময়কার রাজদরবারে এক পণ্ডিত ব্যক্তির আগমন ঘটেছে যিনি এক ডজন ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী ছিলেন। মজার ব্যাপার হল, যখন যে ভাষায় কথা বলে থাকেন তখন মনে হয় এটাই তার মাতৃভাষা। কিন্তু একটা লোকের একাধিক মাতৃভাষা তো হতে পারে না। তাই রাজসভার বাকি পণ্ডিতেরা সবাই রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের শরণাপন্ন হলেন। এ সমস্ত ব্যাপারে রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের একমাত্র ভরসার স্থল ছিল গোপাল ভাঁড়। তিনি গোপালকে ডেকে হুকুম দিলেন এই নবাগত পণ্ডিতের মাতৃভাষা কী, কোথাকার অধিবাসী তা অতি শীঘ্রই জানাতে। গোপাল রাজ হুকুম পেয়ে চৌদিকে মস্তিষ্কের বাতায়ন খুলে ভাবতে লাগলো।
সকাল সকাল রাজসভা আরম্ভ হবার আগে সকল রাজ পণ্ডিতদের সাথে রাজ দরবারের মহা ফটক দিয়ে দরবারে ঢুকতেছে নবাগত পণ্ডিতও। এমন সময় ওপর হতে হঠাৎ নবাগত পণ্ডিতের ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়লো গোপাল ভাঁড়। পণ্ডিত ভয়ে তার মাতৃভাষায় ভয়ার্ত কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো। গোপাল ভাঁড় পণ্ডিতের নিকট ক্ষমা চেয়ে দরবারের দিকে ছুটলো। যথাসময়ে রাজদরবারের কার্যসূচি আরম্ভ হতেই গোপাল ভাঁড় দাঁড়িয়ে বললো–জাঁহাপনা নবাগত পণ্ডিত সিন্ধু প্রদেশের। কোন মানুষ যতই নানান ভাষায় পাণ্ডিত্য করুক হঠাৎ ভয় বা ব্যথা পেলে মাতৃভাষায় চিৎকার দেয়। অতপর আদ্যপান্থ ঘটনা শ্রবণপূর্বক রাজ দরবারে হাসির রোল পড়ে গেল। নবাগত পণ্ডিত স্বীকার করলো সে সিন্ধু প্রদেশের অধিবাসী। গোপাল ভাঁড়ের কথাই ঠিক। ঠিক একই ভাবে অপ্রত্যাশিত ধরা খেয়ে মিয়ান আরেফিন ওরফে বিল্লাল মিয়া গড়গড়ায়ে মাতৃভাষা বলতে লাগলেন। মজার কাণ্ড হল, যখন ইংলিশ বলছিলেন মিয়ান আরেফিন তখন মনে হচ্ছিল তিনি ইংরেজি ছাড়া বাংলা জানেন না। আর যখন ধরা খেয়ে বাংলা বলছিলেন, তখন মনে হলো বেচারা ইংরেজির ছিটেফোঁটাও জানেন না। অথচ তার সাথে কথা বলতে রিজভি সাহেবের মতো অনেককেই তোতলাতে হয়েছে।
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু সাহেব এক বক্তৃতায় বলেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হোক। তিনি বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছেন। এর পূর্বে এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিও পিটার হাসকে বহিষ্কার করতে সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন। আমরা শংকিত যেভাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক বোঁচা করে ফেলছেন মনে হচ্ছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত এই স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রটি বড়ই সঙ্কটাপন্ন। দীর্ঘ নয় মাস অসম যুদ্ধে অর্জিত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভোট কখন হবে কীভাবে হবে তা আমরাই নির্ধারণ করবো কোনও পশ্চিমা রাষ্ট্র নয়। একাত্তরের সংকট কালে তারা কোথায় ছিল? কারা বাঙালি নিধনে বঙ্গোপসাগরে রণতরী প্রেরণ করেছিল? কারা চুয়াত্তরে খাদ্য ভর্তি জাহাজ ফেরত নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ ঘটিয়েছিল তা বাঙালি ভুলেনি। এ দেশের স্বাধীনতায় যাদের পজেটিভ কোন ভুমিকা ছিল না এই দেশের ভাল–মন্দে নাক গলানো তাদের অনধিকার চর্চা বৈ কিছুই নয়। বাংলায় একটা কথা আছে-‘শাসন করা তারই সাজে আদর করে যে’। যারা আমাদের স্বাধীনতা চায়নি, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করে তাদেরকে দেখিয়েছি। আমরা বাংলাদেশকে তলাহীন ঝুড়ি বলা সেই মুখ বন্ধ করে উন্নয়নের প্লাবন ঘটিয়ে বিশেষ তরল পদার্থে তাদের মুখ ধুয়ে দিয়েছি। পদ্মাসেতু নির্মাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কারীদের নিকট বাঙালি হার মানেনি। নিজ অর্থে পদ্মাসেতু করে দুশমনদের মুখমণ্ডল ধৌত করে দিয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো দেশদ্রোহীতা স্বাধীনতা বিরোধীদেরও নাশকতার জন্য একাত্তরে পশ্চিমারা যাদের বন্ধু রূপে পেয়েছিল অধিকাংশ তাদের উত্তরসূরিরাই এখন বাপ–দাদার পদাংক অনুসরণ করে চলছে। পশ্চিমাদের ডেকে এনে চা–বিস্কুট খাওয়ায়ে তাদের নিকট নালিশ করে প্রমাণ করছে তাদের নেতৃত্ব শূন্যতা কিংবা নেতৃত্বের দুর্বলতা। যেন সরকারের নিকট তারা অসহায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একদা আক্ষেপ করে বলেছিলেন–আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা কোন শক্তিশালী বিরোধীদল পাইনি। অবস্থা দর্শনে একথা অস্বীকার করার অবকাশ নেই। জনগণ বলাবলি করছে বিরোধীরা তাদের আগুন সন্ত্রাসে ফিরে গেছে। বিরোধীরা বলছে এটা সরকারের লোকেরাই করেছে। ভিডিও ফুটেজ নিয়ে যাচাই বাছাই তথা তদন্ত চলতেছে। এতগুলো চ্যানেলের ধারণকৃত ফুটেজ তো আর মিথ্যা হতে পারে না। আসলে রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করা উচিৎ। জনগণ হত্যা ভাঙচুর জ্বালাও পোড়াও মিথ্যাচার পছন্দ করে না। ডিজিটাল যুগে মান্দাতার রাজনীতি অচল। সমস্যা আছে, সমস্যা থাকবে সাথে সমাধানও আছে। নিজেদের মধ্যে সমাধান না করে খামোখা বাইরের লোক জমিয়ে তামাশা বানাবার কারণ কী? অনেকদিন আগে বিটিভি’র একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে সম্ভবত ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’। দুই রিকশা ওয়ালার ঝগড়া দেখায়ে সঞ্চালক একটা দারুণ ম্যাসেজ দিয়েছিলেন প্রচলিত সমাজকে। ঘটনাটা হলো পাশাপাশি রিক্সা চালাতে গিয়ে দুই রিক্সার চাকা একটার সাথে আরেকটা লেগে দুই রিঙা জ্যাম হয়ে রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে গেল আরম্ভ হলো দুই রিক্সা চালকের তর্ক–বিতর্ক খিস্তি খেওর। ইতোমধ্যে রাস্তা এক কিলোমিটার জুড়ে ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হল। এক ভদ্রলোক এসে দুজনকে নিবৃত করে চাকা দুটো মুক্ত করে দিলে মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে রাস্তা সচল হয়ে গেল। অথচ এই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তর্ক–বিতর্ক হাতাহাতি লোক জড়ো করে গোটা রাস্তায় জ্যামের সৃষ্টি হয়েছে নির্বোধ লোক দুটোর কারণে। এবং অহরহ আমাদের সমাজে তাই ঘটছে।
লেখক : সাংবাদিক ও রম্য লেখক