পরের দেশে আর বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। আমরা আমাদের জন্মভূমি মিয়ানমারের রাখাইনে ফিরতে চাই। কথাগুলো বলেছেন টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রয় নেওয়া জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবসের আগের দিন গতকাল কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় ক্যাম্পে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ‘গো হোম ক্যাম্পেইন’ কর্মসূচি পালন করেছে রোহিঙ্গারা। এ উপলক্ষে মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে।
ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণকরী রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি বদরুল ইসলাম, আবুল কালাম, ডা. জোবায়ের ও নুরুল আমিন বক্তব্যে বলেন, মিয়ানমার আমাদের মাতৃভূমি সত্ত্বেও আমরা যুগ যুগ ধরে মিয়ানমার সরকার দ্বারা অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছি। ১৯৭৮ সাল থেকে নিয়মিত নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছি। আমাদের গ্রাম ও ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৮, ১৯৯২, ২০১২, ২০১৬, ২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকার আমাদের ওপর একই ধরনের অত্যাচার-নিপীড়ন পরিচালনা করে। মিয়ানমার সরকার আমাদের নিজ দেশ হতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে বিতাড়িত করে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে গণহত্যার মুখে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আমাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে চির কৃতজ্ঞ।
খাদ্য, আশ্রয় এবং অন্যান্য সমর্থন প্রদানের জন্য জাতিসংঘ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ আমাদের জন্মভূমি নয়। আমরা আমাদের জন্মভূমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই।
তাদের প্রশ্ন, ২০১৭ থেকে ২০২২ পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। আমরা কতদিন গৃহহীন থাকব? আমরা আমাদের এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যতের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা মিয়ানমারে আমাদের মাতৃভূমি আরাকানে ফিরে যেতে চাই এবং সঠিক অধিকারের সাথে নাগরিক হিসাবে সেখানে থাকতে চাই। মিয়ানমারে পূর্ণ অধিকারসহ রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত ফিরে যেতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভাষায় ও ইংরেজিতে ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে এসব কর্মসূচিতে যোগ দেয়। সেখানে লেখা ছিল ‘আর কত দিন ..? চলো চলো বাড়ি যাই, চলো মিয়ানমারে যাই’, মিয়ানমার আমাদের মাতৃভূমি, অনুগ্রহ করে জাতিসংঘ, আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে সাহায্য করুন’ ইত্যাদি।
ক্যাম্পেইন চলাকালীন এপিবিএন সদস্যসহ আইনশৃক্সখলা বাহিনী রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও ক্যাম্পেইন ভেন্যুসমূহ পরিদর্শন করে বলে জানান টেকনাফ ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) তারিকুল ইসলাম তারিক এবং উখিয়া ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) নাইমুল হক।
দাবিসমূহ : সমাবেশে নেতারা যেসব দাবি উত্থাপন করেছেন তার মধ্যে রয়েছে ১. অন্যান্য জাতির মতোই আমাদের মূল অধিকার পুনরুদ্ধার করতে হবে। ২. রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা হিসেবেই সম্বোধন বা পরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে। ৩. প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত সময়ের মধ্যে হতে হবে। ৪. মিয়ানমার ট্রানজিট ক্যাম্পে অবস্থানের সময়সীমা কমাতে হবে। ৫. প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করতে হবে। ৬. রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি সদস্যকে স্ব স্ব গ্রামে প্রত্যাবাসন করতে হবে। ৭. প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সাথে প্রতিটি সমঝোতায় ইউএসএ, এলআইএন, ওআইসি, ইউকে, ইইউ, আসিয়ান, বাংলাদেশ, এনজিও ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই জড়িত থাকতে হবে। ৮. রোহিঙ্গারা ঘরে ফেরার পূর্বে তাদের সুরক্ষা দিতে আর২পি অবশ্যই আরাকানে থাকতে হবে। ৯. রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশে পুনর্বাসিত করতে হবে। ১০. রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিযুক্ত করা যাবে না। ১১. কোনোভাবে বা অজুহাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করা যাবে না। ১২. আন্তর্জাতিক মিডিয়া আরাকানের প্রত্যেক এলাকাতে পরিদর্শনের অনুমোদন থাকতে হবে। ১৩. ১৯৮২ সালের নাগরিক আইন বাতিল করতে হবে। ১৪. প্রত্যাবাসনের পূর্বে আরাকানে আইডিপি ক্যাম্প যতটুকু সম্ভব বাতিল করতে হবে। ১৫. রোহিঙ্গাদের জন্য দায়িত্ব থাকতে হবে। ১৬. রোহিঙ্গাদের সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। ১৭. জমি থেকে বায়েজাপ্তকৃত চিংড়ি পুকুর, চারণভূমি রোহিঙ্গাদের ফেরত দিতে হবে।
কর্মসূচিতে নেই পুরাতন রোহিঙ্গারা : কর্মসূচি পালন করেনি পুরাতন ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা। টেকনাফের নোয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্প দুটিতে ১৯৯১-৯২ সাল থেকে অবস্থান করছে প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা। তারা নিজেদের নিবন্ধিত শরণার্থী মনে করে। এসব রোহিঙ্গা ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের একই ধরনের মর্যাদায় বিশ্বাসী নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নোয়াপাড়া নিবন্ধিত ক্যাম্পের এক বাসিন্দা জানান, নতুন রোহিঙ্গারা যদি বাংলাদেশে না আসত এতদিনে আমাদের একটা সুরাহা হতো। হয়তো বাংলাদেশ নাগরিকত্ব বা তৃতীয় দেশে নিয়ে যাওয়া হতো।
অপর এক রোহিঙ্গা জানান, ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশে রয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা বাংলা ও ইংরেজি ভাষাভাষি। এরা বার্মিজ ভাষা জানে না, যার কারণে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে এরা আগ্রহী নন। ফলে ‘গো ব্যাক হোম’ কর্মসূচিতে এদের অংশগ্রহণ ছিল না।