বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) দুটি তেলবাহী জাহাজে পাঁচ দিনের ব্যবধানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা খতিয়ে দেখতে কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের গঠিত ১১ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি সরজমিনে জাহাজ দুইটি পরিদর্শন করেছেন। সেই সাথে তারা সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেছেন। একই ধাঁচের দুইটি ঘটনার মাঝে বড় ধরনের রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে কমিটি। তবে আরো কিছু বিষয়ে অনুসন্ধানের পর কমিটি আগামী সপ্তাহের শুরুতে রিপোর্ট দাখিল করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
কমিটির একজন শীর্ষ পর্যায়ের সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এমটি বাংলার জ্যোতি এবং এমটি বাংলার সৌরভ জাহাজের ফোর পিক স্টোরে বিস্ফোরণের পরই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দুইটি ঘটনা একইরকম বলে কমিটির সদস্যরা ঐক্যমতে পৌঁছেছেন। তবে ঘটনার ব্যাপারে ১১জন সদস্যই নিজেদের মতামত এবং পয়েন্টগুলো লিখে পরবর্তীতে সবগুলো ‘টালি’ করে রিপোর্ট তৈরি করে জমা দিবেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে চট্টগ্রাম বন্দরের ডলফিন জেটিতে ক্রুডঅয়েল খালাসকালে এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজের ফোর পিক স্টোরে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনায় তিনজন নিহত হন। এতে জাহাজটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে ভাগ্যক্রমে জাহাজে থাকা প্রায় ৮৫ কোটি টাকা দামের ক্রুডঅয়েল রক্ষা পায়। এর পাঁচদিনের মাথায় গত ৫ অক্টোবর রাতে বহির্নোঙরে বিএসসির অপর জাহাজ এমটি বাংলার সৌরভেও একইভাবে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় ঘটনায় একজনের প্রাণহানি ঘটে। ঘটনার ব্যাপারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন) খালিদ আহাম্মেদকে প্রধান করে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের পরিচালক অনুপম বড়ুয়া, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বিএসসি) নাজমুন নাহারসহ কোস্টগার্ড, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিপিসি, বিএসসি, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সদস্য করা হয়।
কমিটি গতকাল চট্টগ্রামে এসে সরজমিনে জাহাজ দুইটি পরিদর্শন করেছে। ৩৭ বছরের পুরোনো জাহাজ দুইটির সার্বিক অবস্থা খুবই নাজুক মন্তব্য করে কমিটির শীর্ষস্থানীয় একজন সদস্য দৈনিক আজাদীকে বলেন, দুইটি ঘটনা একইরকম। জাহাজ দুইটির হ্যাজে বিস্ফোরণ ঘটেনি। প্রথমে আগুন লেগেছে জাহাজের সামনের দিকে ফোর পিক স্টোরে। সেখান থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এমটি বাংলার সৌরভ জাহাজে চার স্থানে আগুন দেখা গেলেও কমিটির ধারণা বিস্ফোরণের পর জাহাজ থেকে ছিটকে পড়া লোহার টুকরো বা অন্য কিছুর সাথে চার পয়েন্টে আগুন দেখা গেছে। তবে মূল উৎস ফোর পিক স্টোর।
কমিটির একজন সদস্য বলেন, এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজের ব্যাপারে ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে তাতে ফোর পিক স্টোরে গ্যাস জমা হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এমটি বাংলার সৌরভ জাহাজে ফায়ার ড্রিল করা হয়েছে এবং সেখানের দরজা খোলা রেখে গ্যাস যাতে জমা না হয় সেই ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন স্বীকার করেছেন যে, তিনি ফোর পিক স্টোরে ২৫ শতাংশ গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছিলেন। তবে ২৫ শতাংশ গ্যাসের উপস্থিতি বিস্ফোরণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বিএসসি ইতোমধ্যে দুইটি ঘটনাকে ‘নাশকতামূলক’ বলেছে। কমিটির ওই সদস্য নাশকতার ব্যাপারটিকে উড়িয়ে না দিয়ে বলেন, এর সাথে আরো কিছু বিষয় থাকতে পারে। যেগুলো নিয়েও কমিটির সদস্যরা অনুসন্ধান করছেন এবং প্রয়োজনীয় মতামতসহ আগামী সপ্তাহের প্রথমদিকে রিপোর্ট জমা দেবেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) এই দুইটি জাহাজের উপরই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) জ্বালানি তেল লাইটারিংয়ের পুরো কার্যক্রম নির্ভরশীল ছিল। দুইটি জাহাজই পাঁচদিনের ব্যবধানে ‘ধ্বংস হয়ে যাওয়ায়’ বিএসসি বিদেশী একটি জাহাজ কোম্পানি থেকে ৩০ হাজার টন ধারণক্ষমতার একটি ট্যাংকার ভাড়া করেছে। যা দিয়েই চলছে বিপিসির লাইটারিং কার্যক্রম। এতে আপাতত সংকটের মোকাবেলা করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদী একটি সংকট তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।