রসূলেপাক (দ.) সৃষ্টির মূল এবং আল্লাহর প্রেরিত নূর

ড. মোহাম্মদ আবদুল আজিম শাহ্‌ | সোমবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৮:৪৭ পূর্বাহ্ণ

স্রষ্টার সৃষ্ট দৃশ্যঅদৃশ্য সকল প্রাণ, বৃক্ষ, পাহাড়পর্বত, নদনদী, জীববৈচিত্র্য, গ্রহনক্ষত্র, গ্যালাক্সিব্রহ্মাণ্ড বস্তুকণাসহ সবকিছু মিলে প্রকৃতি। প্রকৃতির বিশালত্ব এতো বেশি যে অনুমান করে করা যায় না। বিজ্ঞান বলছেসমগ্র প্রকৃতির ১০০ ভাগের ৭৫ ভাগ অন্ধকার শক্তি। ২৫ ভাগের ২১ ভাগ এখনো খালি রয়ে গেছে, অবশিষ্ট ৪ ভাগে পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটোসহ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্রহনক্ষত্র, গ্যালাক্সি, এমনকী অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ড অবস্থান করছে। যদিও ঐখানে যাওয়া সম্ভব হয়নি তবে নাসা, CMBL যন্ত্রের সাহায্যে অনুমান করেছে। প্রাচীন মুনিঋষিগণও এই বিষয়ে বলে গিয়েছেন। প্রকৃতি যেখান থেকে সৃষ্টি হয়েছে তা হল মূলপ্রকৃতি। অর্থাৎ সৃষ্টির মূল; যা স্বতঃ, রজঃ, তমঃ ত্রিবিধ গুণের সমাহার। এই মূল প্রকৃতি হল আল্লাহর নূর। নূর কী? নূর অর্থ আলো। নূর অর্থ জ্ঞানশক্তি, অন্তঃআলোক শক্তি, নূর অর্থ (চেতনা নামক উচ্চ অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন) আধ্যাত্মিক শক্তি। নূর মানে স্বীয় সত্তা, নূর মানে স্বধানামক ‘আমিশক্তি’ (আদিশক্তি)। বিজ্ঞানের ভাষায় the ultimate power। মূলত নূর হল আল্লাহ রাব্বুলআলামিনের খামচি দিয়ে আলাদা করা নূরের খণ্ডিতরূপ। এই নূর বা শক্তি; সৃষ্টির আদিতে গুপ্তসূক্ষ্ম জগতে সৃষ্টির মূলাধার ( আহমদ) রূপে বিরাজমান ছিলেন। এই নূর স্বয়ং রসূলেপাক (.)। রসূল(.) নূর থেকেই সৃষ্টিকুল সৃজন হয়েছে। এজন্য মূলত তিনি সৃষ্টির মূল। তাই রসূলেপাক (.)’র অনেক নামের একটি নাম উম্মিয়্যুন (অর্থাৎসমগ্র সৃষ্টিজগতের মূল)। রসূলেপাক (.) মানবীয়রূপে ধরাধামে আগমনের অনেক পূর্ব থেকেই রুহানিজগতে আলোজ্ঞানবেলায়তের শক্তি হয়ে বিচরণ করতেন। বিগব্যাংয়ের অনেক পূর্বে যখন চেতনা, স্বপ্নের জগৎ কল্পনা, রাতদিন, গ্রহনক্ষত্র, ব্রহ্মাণ্ডমহাকাশ কিছুই ছিল না। শুধু ঘোর অন্ধকার আর অন্ধকার। শুধু এক সে.মি.-কে একের সাথে সাতচল্লিশটি (১ সে.মি স্থানকে / ১এর সাথে ৪৭টি শূন্য জোড়া লাগিয়ে তা দিয়ে ভাগ করলে ফলাফল যা হয়, সেই পরিমাণ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্থান ছিল। সুক্ষ্ম স্থানেই ছিল মূল প্রকৃতি। যা একটি আবরণে আবৃত ছিল। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্থানে স্রষ্টা নিজের ভাবে নিজে বিভোর ছিলেন। ঐ সময়ে ‘স্বধা’ নামক চেতনা স্পন্দিত হতে থাকে। (‘স্বধা’ অর্থ স্বস্বয়ং, ধাধারণকারী।)সূক্ষ্মগুপ্ত স্থানে আল্লাহ ও আল্লাহর রসূল (.) একে অপরের সাথে এমনভাবে মিশে থাকতেন যে পৃথক করার সুযোগ নেই। দুইয়ে মিলে এক। যেরকম ডালের দুটি অংশ অভিন্ন হয়ে একে অপরের সাথে আবরণে আবৃত থাকে যে, আলাদা করার সুযোগ নেই। ডালকে যখন ভাঙা হয় তখন দুটি অংশ দৃশ্যমান হয়। আল্লাহ রাব্বুলআলামিন হঠাৎ নিজেকে প্রকাশ দেওয়ার ইচ্ছা করেন। তখন নিজেকে খামচি দিয়ে একটি অংশ আলাদা করেন। হাদিসে কুদসিতে আছেআল্লাহ বলেন, ‘কুন্‌তু কানান মাখপিয়ান ফাআহাব্বু আনওরাফা ফাখালা কতুল খালফা লিউরাফা’ অর্থাৎ-‘ আমি সুপ্তস্থানে গুপ্ত ছিলাম, হঠাৎ নিজেকে প্রকাশ দেওয়ার ইচ্ছা হলো। নিজেকে প্রকাশ করলাম। এটি আল্লাহর নূরের খণ্ডিত রূপ। অংশটি আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে প্রশংসাকারী (আহমদ) হয়। আহমদ, আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে স্বয়ং প্রশংসিত করতে করতে মোহাম্মদে পরিণত হয়। এসব কর্মকাণ্ড ঘটেছে রুহানিয়তের জগতে। তখনও সৃষ্টিজগৎ সৃজন হয়নি। এই নূর পরবর্তীতে জ্ঞান বা আধ্যাত্মিক শক্তিরূপে প্রকাশিত হয়েছে। স্রষ্টা নিজেকে প্রকাশ দেয়ার ইচ্ছা করলে ‘চেতনা’ নামক শক্তি প্রতিনিয়ত স্পন্দিত হতে থাকে। স্পন্দনের ফলে মূলশক্তি তিন শক্তিতে পরিণত হয়। যথা) সত্ত্বঃ জ্ঞানশক্তি। ২) রজঃ; ইচ্ছাশক্তি। ৩) তমঃশ্যাম (কালো); ক্রিয়াশক্তি। এই তিন শক্তি থেকে ধীরে ধীরে প্রকৃতির বিস্তার হয়। কোনো কিছু তৈরি করতে প্রথমে চেতনা (জ্ঞানশক্তি)। চেতনা থেকে ইচ্ছা, এরপর পরিকল্পনা। পরিকল্পনা ব্যতীত কিছু নির্মাণ সম্ভব নয়। এ শিক্ষা স্রষ্টাপ্রদত্ত। হাদিসে কুদসিতে আছে, ‘কুন্‌তু কানান মাখপিয়ান ফাআহাব্বু আনওরাফা ফাখালা কতুল খালফা লিউরাফা’ অর্থাৎআমি সুপ্তস্থানে গুপ্ত ছিলাম, হঠাৎ নিজেকে প্রকাশ দেওয়ার ইচ্ছা হলো, তখন নিজেকে প্রকাশ করলাম। তিনি জ্ঞান শক্তিকে ইচ্ছাশক্তি, ক্রিয়াশক্তিকে ক্রিয়াশক্তিতে পরিণত করবেন। পবিত্র কোরআন শরিফের ভাষায় ‘কুন ফায়াকুন’ অর্থাৎ হও, হয়ে যাও; তখন প্রকৃতির নির্মাণ শুরু হয়। সৃষ্টিততেত্ত্বর গবেষণা বলেস্রষ্টা সূক্ষ্মস্থানে বহুকাল গুপ্ত থাকার পর নিজেকে প্রকাশ দেয়ার ইচ্ছা করলে ১৩.৭ বিলিয়ন বছর পূর্বে (বিগব্যাংয়ের সময়) সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্পেসের বৃহৎ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের ফলে মহাজাগতিক রশ্মির ধুম্র (ধোঁয়া), ধুম্র থেকে ধূলিকণার বৃষ্টি আরম্ভ হয়। যাকে রজঃ বলে। রজঃ থেকে আকাশ (বৃহৎ স্পেস) সৃষ্টি হয়। পবিত্র কোরআন আছে আল্লাহ বলেন,-‘তিনি আকাশে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল পূর্বে ধোঁয়া (ধুম্র কণা), এরপর আকাশ ও জমিনকে আদেশ করেন তোমরা এগিয়ে এসো ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা অনুগত আছি। অতএব তিনি দুদিনের মধ্যে ধোঁয়া থেকে সপ্তাকাশ নির্মাণ করেন এবং প্রতিটি আকাশে আদেশনামা প্রেরণ করেন। পরিশেষে আমি নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্র দ্বারা সাজিয়ে দিলাম এবং শয়তান (নেগেটিভ এনার্জি) থেকে সংরক্ষিত করলাম।’ (সূরা হামিম, আয়াত ১১ ও ১২)। অতএব সৃষ্টি নির্মাণের প্রথম হল আকাশতত্ত্ব (স্থান)। এভাবে সৃষ্টিজগৎ নির্মাণ হয়। অতএব যখন কিছুই সৃষ্টি হয়নি তখনও জ্ঞান বা আধ্যাত্মিক শক্তি হয়ে রসূলপাক (.)-এঁর অস্তিত্ব ছিল। রসূল (.) বলেন,-‘যখন সৃষ্টির কিছুই ছিল না, তখনো আমার অস্তিত্ব ছিল’।

রসূলেপাক (.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর নূর থেকে, সমগ্র সৃষ্টি আমার নূর (আলো /জ্ঞান) থেকে সৃষ্টি হয়েছে।‘ (তাফসিরে রুহুল বায়ান, ২য় খণ্ড)। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি জ্ঞানের দ্বারা সকল কিছুকে ব্যক্ত করেছেন। (সূরাতু য়াহা ৯৮)। সাহাবা হজরত জাবের (রা.), রসূলেপাক(.)-এর নিকট প্রশ্ন করেন, সবকিছুর পূর্বে আল্লাহ কী সৃষ্টি করেন? তিনি বলেন, ‘সর্বপ্রথম আল্লাহর নূর হতে আপনার নবীর নূর উৎপত্তি হয়েছে’।এই ‘আহমদ’ রূপ (নূর) সৃষ্টির আদিতে গুপ্তসূক্ষ্মজগতে সৃষ্টির ‘মূলাধার’ রূপে বিরাজমান ছিলেন। সৃষ্টিজগৎ সৃজন হওয়ার বহুবছর পর ‘আহমদ’ কল্যাণকর ত্রাণকর্তারূপে ‘মোহাম্মদ’ নামে বিকশিত হয়েছেন। এবং মানবীয়রূপে আগমন করে ‘আহমদী’ রূপের বিকাশ দিয়ে দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতকে পরিচালনা করেছেন। হজরত মুসা (.) কে আল্লাহ বলেন,- ‘হে মুসা! বনিইসরাইলকে বলে দাও; যে কেহ আমার কাছে আসিবে সেই ব্যক্তি ‘আহমদ’ কে অস্বীকার করবে তাকে দোযখে নিক্ষেপ করব। মুসা(.) বললেন, হে খোদা! ‘আহমদকে? আল্লাহ বলেন, ‘আমার ইজ্জত ও জালালিয়াতের কসম; তিনি ছাড়া অত্যধিক সম্মানিত আমার নিকট আর কেউ নয়’। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সমগ্র সৃষ্টিজগতের নেয়ামতস্বরূপ দোজাহানের বাদশা, তাজেদারে মদিনা হজরত আহমদ মোজতবা মোহাম্মদ মোস্তফা (.) নামে মানবীয়রূপে ধরাধমে আগমন করেন। আর আগমনে কূল কায়েনাত হয়েছে ধন্য। সমগ্র সৃষ্টির নেয়ামতস্বরূপ তাঁর আগমনী দিনকে স্মরণপূর্বক প্রেমিকগণ যার যার তরিকার রীতি অনুসরণ করে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আল্লাহর শোকরিয়া আদায়সহ আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী (.) পালন করেন। শুধু ঈদ নয় বরং ঐদিন সকল ঈদের সেরা ঈদ হিসেবে প্রেমিকগণ ওই দিবস উদযাপন করে। ঐদিন আকাশ, বাতাস ফেরেস্তাসহ কুলকায়েনাত আনন্দে আত্মহারা হয়ে দরূদশরিফ পাঠ করে রসূলে পাক (.) কে বিশেষভাবে স্মরণ করেন। ঐ দিন ছাড়াও বছরের যেকোনো দিনেও ঈদে মিলাদুন্নবী (.) পালন করা যায়। আর এটি পালনের জন্য কোনো দলিলের প্রয়োজন নেই। এটি প্রেমিকদের হৃদয়ের খোরাক।

অতএব রসূলেপাক (.) স্রষ্টার রূপগুণের বহিঃপ্রকাশ। তিনি কোনো সৃষ্টি নয়; বরং তাঁর নূর থেকে সমগ্র কুল কায়েনাত সৃষ্টি হয়েছে। তিনি সৃষ্টির মূল। তিনি নূরের তৈরি নয় বরং স্বয়ং নূরের ধারক। আল্লাহ বলেন– ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে নূর’ (সুরা মায়িদা, আয়াত১৫)। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)’র ‘ইবনে আব্বাস’এ আছে এই নূর হল হজরত আহমদ মোজতবা মোহাম্মদ মোস্তফা (.)। যেহেতু আল্লাহ নিরাকার, নিরঞ্জন অসীম। আল্লাহকে দেখা ও পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু প্রেরিতকে দেখা যায়। তাই রসূলেপাক (.) আল্লাহর গুণ, শক্তি ও বেলায়তের ক্ষমতা নিয়ে অবতাররূপে মোহাম্মদ নামে প্রকাশিত হয়েছেন।

সৃষ্টির আদিতেও তিনি, অন্তেও তিনি, গোপনেও তিনি, প্রকাশ্যেও তিনি। সৃষ্টি নির্মাণের পূর্ব থেকে যাঁর অস্তিত্ব, তিনি নিঃসন্দেহে মহাসত্তার রূপ। তিনি মোহাম্মদী রূপে প্রেরিত হয়ে নবুয়ত প্রচার করেছেন। আবার আল্লাহর বেলায়তের শক্তি নিয়ে আগমন করে ‘আহমদী’ রূপের বিকাশ দিয়ে দৃশ্যঅদৃশ্যসহ সমগ্র সৃষ্টিজগত পরিচালনা করেন। এজন্য সুবুদ্ধির অনুসারীগণ রসূলেপাক (.)-কে কখনো সৃষ্টি মনে করে না, স্রষ্টাও মনে করে না। তবে মহাসত্তা থেকে পৃথক কোনো সত্তাও মনে করে না।

তিনি আগমন করে প্রচার করেছেন আল্লাহর একত্ববাদের বাণী। অন্ধকারের থেকে আলোর দিকে ধাবিত করেছেন। দিয়েছেন সত্যের সন্ধান ও শান্তির বার্তা। শুনিয়েছেন সাম্যের বাণী। ফিরিয়ে দিয়েছেন বঞ্চিত মানুষের অধিকার। জালিমের হাত থেকে বিশ্বমানবতাকে রক্ষা করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে সতর্ক করেছেন। জাগতিক লোভ, মোহ ত্যাগ করে স্রষ্টামুখি হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। ঈদে মিলাদুন্নবী(.)’র উসিলায় আল্লাহ রাব্বুলআলামীন সকলকে ক্ষমাসহ দয়া করুন; এই ফরিয়াদ জানাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক, সাজ্জাদানশীন, মতিভাণ্ডার দরবার শরিফ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজাদীর আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে