তাজেদারে মদীনা রহমতুল্লিল আলামিন হযরত আহমদ মোজতবা মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.) হলেন পূর্ণ নূর। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নূরের অংশ। নূরের অংশ এবং নূর থেকে সৃষ্ট, দুটোর মধ্যে আসমান–জমিন ব্যবধান। কতকলোক বিশ্বাস করেন তিনি মাটির তৈরী, কারণ ভৌতভাবে তিনি হযরত আবদুল্লাহ (রা.) ও হযরত মা আমেনা (আ.)’র সন্তান। অর্থাৎ মানবীয়রূপে প্রেরিত হয়েছেন। আবার কেউ বলেন, নূরের তৈরী। মূলত তিনি মাটির তৈরীও নয়, নূরের তৈরীও নয়; বরং তিনি স্বয়ং নূর। তিনি সৃষ্টির মূল। এজন্য তাঁর অনেক নামের একটি নাম উম্মিয়্যুন (সমগ্র সৃষ্টিজগতের মূল)। নূরের অংশ ও নূরের সৃষ্টি; দুটো ভিন্ন অর্থ বহন করে। যেমন–একটি বড়বাটি থেকে কিছু দুধ দুটি পাত্রে রাখলে এই দুধ মূল বাটির দুধের অংশ। পাত্রদুটির দুধ পুনরায় বাটিতে মিশ্রিত করলে একাকার হয়ে যাবে। পাত্রদুটির দুধ, মূল বাটির দুধ থেকে নতুন সৃষ্ট কোনো উপাদান নয়। অপরদিকে সৃজন করা মানে এক উপাদানের সাথে অন্য উপাদানের মিশ্রণে নতুন (তৃতীয়) বস্তু তৈরি করা। যেমন–দুধ থেকে ঘি, দই, মাখন ইত্যাদি তৈরী হয়– যেটি নতুন সৃষ্টি। তদ্রুপ আল্লাহর নূর থেকে খামচি দিয়ে আলাদা করা অংশ রসূলেপাক (দ.)’র নূর। তাই রসূল (দ.) নূরের তৈরী নয় বরং তিনি আল্লাহর নূরের অংশ। নূর মানে আলো। নূর মানে জ্ঞানশক্তি, নূর মানে বেলায়তের শক্তি। জ্ঞানশক্তি থেকে সমগ্র সৃষ্টি সৃজন হয়েছে। বিজ্ঞান বলে–বিগব্যাংয়ের বহুপূর্বে যখন চেতনা ছিল না, চেতনা থেকে যা জানা যায়, তা–ও ছিল না। অচেতনাও ছিল না, অচেতনা থেকে যা জানা যায়, তা–ও ছিল না, স্বপ্ন, স্বপ্নের জগৎ, বাস্তবতা, কল্পনা, রাত–দিন, গ্রহ–নক্ষত্র, ব্রহ্মাণ্ড–মহাকাশ কিছুই ছিল না। বায়ু, পানি ছিল না, তাই প্রাণও ছিল না। শুধু এক সে.মি.কে একের সাথে সাতচল্লিশটি শূন্য জোড়া লাগিয়ে তা দিয়ে ভাগ করলে ফলাফল যা হয়, সেই পরিমাণ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্থান ছিল। এই সূক্ষ্মস্থানেই ছিল মূলপ্রকৃতি। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এস্থানে স্রষ্টা নিজের ভাবে নিজে স্বধা‘ নামক ‘আমিশক্তি‘রূপে বিভোর থাকতেন। স্বধা অর্থ (স্ব–স্বয়ং, ধা–ধারণকারী) স্বয়ং ধারণকারী। স্বধা শব্দ অবেস্তা ভাষায় খদা শব্দে পরিণত হয় এবং পরবর্তীতে পেহলভি হয়ে ফার্সি ভাষায় খদা শব্দ খোদাতে পরিণত হয়। ( খোদা অর্থ –আমি স্বয়ং)। কোনোকিছু তৈরী করতে প্রথমে চেতনা আসে। চেতনা থেকে কামনা, এরপর পরিকল্পনা। পরিকল্পনা ব্যতীত কিছু নির্মাণ সম্ভব নয়। পরিকল্পনার পর কামনা, কামনা থেকে ইচ্ছা। এরপর ইচ্ছাকে কার্যে পরিণত করতে হয়। তদরূপ স্রষ্টা প্রথমে নিজেকে প্রকাশ করার চেতনা জাগ্রত হয়, চেতনা থেকে পরিকল্পনা। পরিকল্পনাকে বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্য ইচ্ছাশক্তির উদয় হয়। এরপর ইচ্ছাকে ক্রিয়াশক্তিতে পরিণত করবেন তখন আল্লাহ ‘কুন ফায়াকুন‘ বলেন, (অর্থাৎ-‘ হও, হয়ে যাও); তখন মূলশক্তি তিনশক্তিতে পরিণত হয়ে সমগ্র সৃষ্টির নির্মাণ শুরু হয়। অর্থাৎ সত্তঃ, রজঃ, তমঃ গুণের সৃষ্টি হয়। এজন্য রসুলপাক(দ.) এই তিন গুণের অধিকারী। বিজ্ঞানের ভাষায়– বিগব্যাংয়ের সময় সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম স্পেসের বৃহৎ ধ্বনির বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টির নির্মাণ শুরু হয়। এরপর পঞ্চতত্ত্ব, গ্রহনক্ষত্র, গ্যালাক্সি,চন্দ্র, সূর্য, গাছপালা, প্রাণীসহ সমগ্র সৃষ্টি সৃজন হয়। হাদিসে কুদসিতে আছে,- ‘কুন্তু কানান মাখপিয়ান ফাআহাব্বু আন–ওরাফা ফা–খালা কতুল খালফা লিউরাফা‘। অর্থ –আমি সুপ্তস্থানে গুপ্ত ছিলাম, হঠাৎ নিজেকে প্রকাশ দেওয়ার ইচ্ছা হলো, তখন নিজেকে প্রকাশ করলাম’। সৃষ্টির আদিতে আল্লাহ নিজের মধ্যে নিজে বিভোর থাকতেন। এই অবস্থায় নিজেকে প্রকাশ দেওয়ার কামনা হলে নিজেকে খামচি দিয়ে একটি অংশ আলাদা করেন। এই অংশটি আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে আহমদ (প্রশংসাকারী) এবং আহমদ, আল্লাহর গুণকীর্তন করতে করতে স্বয়ং মোহাম্মদ (প্রশংসিত) হয়ে যায়। খামচি দিয়ে আলাদা করা অংশটি মূলতত্ত্ব হয়ে, আল্লাহর আধ্যাত্মিক শক্তিরূপে সৃষ্টির আদিতে (ভাবজগতে) বিরাজমান ছিল। স্রষ্টার প্রথম প্রকাশ জ্ঞানশক্তিই (নূর) প্রেরিত রসূলেপাক (দ.)। এজন্য রসূলেপাক (দ.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর নূর থেকে, সমগ্র সৃষ্টি আমার নূর থেকে সৃষ্টি হয়েছে’। সৃষ্টিজগত সৃজন হওয়ার বহুবছর পর বেলায়তের শক্তি ধারণ করে খতমে নবুয়ত হয়ে ১২ রবিউল আউয়াল সমগ্র সৃষ্টির রহমত হিসেবে ভৌতজগতে মানবীয়রূপে প্রেরিত হয়েছেন। আহম্মদ ও মোহাম্মদের সমন্বয়ে মোহাম্মদ মোস্তফা(দ.)’র আগমন হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আগমন হয়েছে এক টুকরো নূর’ (সূরা মায়েদা –১৫)। সুফিসাধকগণ বলেছেন, এই নূর –স্বয়ং রসূলে পাক (দ.)। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)’র তাফসির গ্রন্থ ‘ইবনে আব্বাস‘-এ আছে এই নূর হলেন –হযরত আহমদ মোজতবা মোহাম্মদ মোস্তাফা (দ.)। হযরত জাবের (রা.), রসূল (দ.)-‘র নিকট প্রশ্ন করেন, সবকিছুর পূর্বে আল্লাহ কী সৃষ্টি করেন? তিনি বলেন, ‘সর্বপ্রথম আল্লাহর নূর হতে আপনার নবীর নূর সৃষ্টি করেন’। তিনি আগমন করে মানবকে শুনিয়েছেন শান্তির বাণী, অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগকে করেছেন আলোকময়, দিয়েছেন যুগোপযোগী ধর্ম ইসলাম, ফিরিয়ে দিয়েছেন বঞ্চিত মানুষের অধিকার। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করার জন্য সতর্ক করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন একত্ববাদ। অপরদিকে বেলায়তের শক্তি দ্বারা মানবের লুকায়িত চেতনাকে জাগ্রত করে আল্লাহর সাথে বান্দার মিলনের পথকে সুগম ও সহজ করেন। আধ্যাত্মিক শক্তি দ্বারা দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের সুপ্রিম অথরিটি হয়ে আধ্যাত্মিক প্রশাসন পরিচালনার মাধ্যমে সমগ্র প্রকৃতির কল্যাণ করেন। এককথায় –সৃষ্টি নির্মাণের পূর্ব থেকে যাঁর অস্তিত্ব, তিনি নিঃসন্দেহে মহাসত্তার রূপ। সৃষ্টির আদিতেও তিনি, অন্তেও তিনি, গোপনেও তিনি, প্রকাশ্যেও তিনি।তাঁর আগমন আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত।নেয়ামতের শুকরিয়া ও রসূলেপাকের আগমনের বিশেষ দিনকে স্মরণ করে রসূলপ্রেমিক,আকাশ বাতাস, বৃক্ষ –তরুলতা, ফেরেশতাকুলসহ এমনকী সমগ্র প্রকৃতি আনন্দে আত্মহারা হয়ে আদব ও ভক্তিচিত্তে ঈদ হিসেবে ঈদ–এ মিলাদুন্নবী(দ.) পালন করেন। শুধু তাই নয়; বরং রসূলপ্রেমিকগণ বরকতময় এই দিনকে সকল ঈদের সেরা ঈদ হিসেবে উদযাপন করেন। যুগে যুগে সুফি–সাধকগণ এই দিবসকে পালন করে আসতেছে, এখনো পালিত হয়। এই শিক্ষা আমরা গুরুপরম্পরায় পেয়েছি। এটি পালন করার অনেক দলিল–প্রমাণ আছে। তারপরও আমি মনে করি এ দিবসকে উদযাপন করার জন্য বিশেষ কোনো দলিল –ফতোয়ার প্রয়োজন নেই। এটি নবী–অলিপ্রেমিকদের হৃদয়ের খোরাক। এটি সম্পূর্ণ অনুভূতি ও উপলব্ধির বিষয়। যার অনুভূতি রয়েছে, হৃদয়ে রসুলের মহব্বত রয়েছে; তাঁর জন্য এ দিবস স্মরণ অত্যাবশ্যক। আল্লাহ, যেদিন জান্নাত থেকে হযরত মুসা (আ.)’র জন্য খাদ্য পাঠিয়েছেন; শুকরিয়াস্বরূপ হযরত ঈসা (আ.) নেয়ামতপ্রাপ্তির দিন হিসেবে আনন্দের সহিত ঐদিন ঈদ পালন করতেন। তাহলে আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত হিসেবে যেদিন রসূল (দ.)কে সমগ্র সৃষ্টির রহমত হিসেবে আমাদের মাঝে প্রেরণ করেছেন, এর চেয়ে আনন্দের দিন আর কী হতে পারে? সেই দিনকে স্মরণে নবী–অলিপ্রেমিকরা শুধু ঈদ নয় বরং সকল ঈদের সেরা ঈদ হিসেবে পালন করেন। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা -‘তোমরা আমার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় কর’। নবী–অলিপ্রেমিকরা দরুদ পড়ে, কেউ নফল রোজা, নফল নামাজ, ফাতেহা, খাওয়ার আয়োজন, কেউ জুলুসের মাধ্যমে জিকির করে, কেউ বাদ্যবাজনা, কাওয়ালীর মাধ্যমে দরুদ শরীফ পেশসহ যে যার মত বিভিন্ন তরিকার রীতি–নীতি অনুসরণপূর্বক আশেকজন ঈদ–এ–মিলাদুন্নবী(দ.) পালন করেন। তিনি কোনো সৃষ্টি নয়, সৃষ্টির কোনো অংশও নয়; বরং সৃষ্টির মূল। সহজ কথায় সৃষ্টি নির্মাণের পূর্ব থেকে যার অস্তিত্ব বিদ্যমান তিনি নিঃসন্দেহে মহাসত্তার রূপ–গুণ–নূরের বহিঃপ্রকাশ। তিনিই হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.)। অতএব তিনি মাটির তৈরীও নয়, নূরের তৈরীও নয়; বরং তিনি আল্লাহর নূরের অংশ, নূরের খনি, নূরের ধারক। অতএব তিনি নূর থেকে কিংবা মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছেন, এটা চিন্তা করাও পাপ। যারা বলে, তিনি নূরের তৈরী, তারা তাঁর শান ও মর্যাদায় আঘাত করছেন। একইভাবে যারা মাটির তৈরী বলতেছেন তারা অধিকতর রসূল (দ.)’র শান ও মর্যাদাকে হেয় করার অপচেষ্টা করছেন। মানবীয়রূপে আগমন করলেও তিনি কোনো ব্যক্তি নয় বরং মহাসত্তা হিসেবে উপলব্ধি করতে পারলে তাঁকে নিয়ে, তাঁর শান নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসবে। বরকতময় দিন সকল ঈদের সেরা ঈদ; ঈদ–এ মিলাদুন্নবী (দ.)’র উসিলায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের অপরাধ মার্জনা করে জগতের সকলকে কামিয়াবি দান করুক, এই প্রার্থনা করি। (আমিন)।
লেখক: প্রাবন্ধিক, গকেষক। সাজ্জাদানশীন, মতিভাণ্ডার দরবার শরিফ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।