বইয়ের নাম ‘উল্টো থেকে’। লিখেছেন আবদুল মালেক। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ –রফিকুন্নবী (রনবী)। প্রকাশক– কোহিনূর লাইব্রেরী, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম। প্রথম প্রকাশ– ১লা বৈশাখ ১৩৯৬, ১৪ এপ্রিল ১৯৮৯। দ্বিতীয় প্রকাশ–ফেব্রুয়ারি,২০২৫।
আমরা জানি বাংলা সাহিত্যে রম্যসাহিত্য একটি উল্লেখযোগ্য ধারা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী, সৈয়দ মুজতবা আলাী, বানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আবুল মনসুর আহমেদ, নুরুল মোমেন প্রমুখ রম্যরচনা লিখে সহজেই পাঠকের মন জয় করেছিলেন। চট্টগ্রামের লেখক চৌধুরী জহুরুল হক, রনজিৎ বিশ্বাস, ফাহমিদা আমিনও এ বিষয়ে বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁদেরই পথ অনুসরণ করে রম্যরচনায় আগ্রহী হয়েছেন আজকের আলোচ্য লেখক আবদুল মালেক। দৈনিক আজাদীর সুযোগ্য সম্পাদক হিসেবে সমাজে তাঁর সুপরিচিতি রয়েছে। আরও আছে সমাজসেবক হিসেবে তাঁর সর্বজনগ্রাহ্যতা। বিভিন্ন সভা–সমিতিতে তাঁর বক্তব্য যাঁরা শুনেছেন তাঁরা জানেন তিনি একজন রসিক বক্তা। খুব সাধারণ একটি কথাকেও তিনি রসময় ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করতে পারেন। তাঁর এই রসবোধই তাঁকে একজন রম্যলেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাঁর ‘উল্টো থেকে’ গ্রন্থের ষোলটি রচনাই পাঠককে রম্যরচনার স্বাদ দিয়েছে। তিনি যেমন একজন রসবোধসম্পন্ন বক্তা, তেমনি রম্যলেখক হিসেবেও পুরোপুরি সার্থক। আমরা আজ তাঁর কয়েকটি রম্যরচনা নিয়ে সীমিত পরিসরে আলোচনা করবো।
‘উল্টো থেকে’ গ্রন্থের প্রথম রচনা ‘পিন সমাচার’। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পিনের যে কতরকম প্রয়োগ, তা তিনি এ লেখায় চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। পিন যেমন লাগে অফিসের কাগজপত্রকে ফাইলবন্দী করতে, তেমনি লাগে পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশটি কেটে নিতে। আবার গিন্নীর সাথে খিটিমিটি লাগলে আপনি যেমন তাঁকে কথার পিন ফোটাতে ছাড়েন না, তেমনি তাঁর কথার পিনও আপনাকে হজম করতে হয়। পিন যেমন লাগে খাওয়ার পরে দাঁত খিলাল করতে, তেমনি লাগে লোকাল বাসে নিজের জন্য আসন বরাদ্দ করতে। লেখকের ভাষায়–
‘অফিস ছুটি। একটা পিন দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে চলেছেন। বাসে উঠলেন। কন্ডাক্টার আপনাকে কোনো প্রকারে আধা বসা বসিয়ে দিলো। আপনি বড় অসুবিধা বোধ করছেন। হঠাৎ মনে হলো পিনের কথা। ব্যস, সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। পিনের ডগাটা পাশে বসা ভদ্রলোককে একটু করে ছোঁয়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন। উনি একটু নড়ে উঠলেন। এই ফাঁকে আপনিও নড়েচড়ে জাঁকিয়ে বসে গেলেন।’ এই লেখা পড়তে পড়তে পাঠকের ঠোঁটের কোণে দেখা যাবে এক চিলতে হাসি।
এ গ্রন্থের আরেকটি রচনা ‘উল্টো থেকে’। এ রচনাটিতে লেখক অত্যন্ত শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে আত্মকথনের মাধ্যমে চমৎকার কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। লেখক সদ্য গাড়ি কিনেছেন। গাড়ি কেনার পরে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি গেলো পাল্টে। লেখকের ভাষায়-‘যখন নিজে রাস্তায় হাঁটতাম তখন মনে হতো, সব গাড়িওয়ালা রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতের উপর দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছে। আর এখন গাড়ির মধ্যে বসে মনে হয়, তার ঠিক উল্টোটা। অর্থাৎ সব পথচারী ফুটপাত ছেড়ে রাস্তাটা দখল করে হাঁটছে।’ তিনি গাড়ি কিনেছিলেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নিয়মিত যাবেন বলে। অথচ এখন তাঁর মনে হয় ওই সরু গলিতে গাড়ি নিলে গাড়ির চৌদ্দটা বাজবে। অগত্যা আত্মীয়স্বজনের কাছে তিনি এখন অমাবস্যার চাঁদ। ছেলেমেয়েরা নতুন কিছু শিখবেন বলে কিনেছিলেন টিভি। দেখা গেলো সেই টিভি অহর্নিশ দেখতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা সব পরীক্ষায় ডাব্বা। এসব মজার কথা শোনাতে শোনাতে লেখক একসময় হাস্যরসাত্মক ছলে সরকারি সংস্থার গালে কষে মারলেন চড়। তাঁর গাড়ি নিয়ে মসৃণ রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে জানলেন ওই রাস্তা ওয়াপদার তৈরি করা। অথচ রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের তৈরি রাস্তায় বড় বড় গর্তের জন্য গাড়ি চালানো দুরূহ। সাথে সাথে লেখকের মাথায় এলো, ‘ওয়াপদা যখন বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় অকর্মণ্য অথচ রাস্তা বানানো ও তা রক্ষায় ওস্তাদ তখন তাদেরকে রাস্তা বানানোর দায়িত্ব দেয়া যাক। আর রোডস অ্যান্ড হাইওয়েকে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে দেওয়া হোক। তাহলে হয়তো অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে।’ আমাদের সরকারি সংস্থাগুলো যে কীরূপ জনভোগান্তির কারণ তা তিনি এ রচনায় সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন।
এই গ্রন্থে রিভলভিং রেস্তোরাঁ নিয়ে দারুণ মজার একটা লেখা আছে ‘চক্কর’ নামে। একবার লেখক গিয়েছিলেন জার্মানির মিউনিখ শহরে। গাইডের পরামর্শ মতো খেতে গেলেন ২০০০ ফুট উঁচু টাওয়ারের রেস্তোরাঁতে। খাওয়ার অর্ডার দিয়ে হঠাৎ লেখক টের পেলেন– ‘মাথাটা যেন কেমন ঘুরে উঠলো। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার সামনে সমস্ত দুনিয়াটা ঘুরছে। ঐ যে নিচের নদীটা, রাস্তাটা, ফ্যাক্টরিটা–সব কিছুই ঘুরে ওদিকে চলে যাচ্ছে।’ লেখক ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন। এমন মাথা ঘুরলে তিনি খাবেন কী করে? চারপাশটা দেখবেনও বা কী করে? তাঁর ভ্যাবাচেকা নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে গাইড শেষে তাঁকে সব বুঝিয়ে বললেন। বললেন– ‘তোমার মাথাটা মোটেই ঘুরছে না। ওটা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। আসলে ঘুরছে আমাদের এই সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্টটা। আমারই ভুল হয়ে গেছে। আগেই বলা উচিত ছিল সে কথা। এটা একটা রিভলভিং রেস্টুরেন্ট।’ লেখকের এর আগে এমন রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভিজ্ঞতা না থাকলেও চট্টগ্রামবাসী অবশ্য এর কয়েকবছর পরে এমন রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছিল চান্দগাঁও স্বাধীনতা কমপ্লেক্স এর রিভলভিং রেস্টুরেন্টের মাধ্যমে।
এ গ্রন্থের আরেকটি চমৎকার রম্যরচনা ‘হাইজ্যাক’। ছোট্ট একটি রাস্তায় ঘোর অন্ধকারে দুটি গাড়ি পরস্পরের পথ আটকালো। কিছু বোঝার আগেই এক গাড়ি থেকে নেমে এলো দুইজন। হাতে তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। একজন বললো, ”গাড়ি থেকে নেমে চাবিটা আমাদের দিয়ে কেটে পড়ুন।’ সাথে সাথে অপর গাড়ি থেকেও নেমে এলো চারজন। তাদের হাতেও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। বোঝা গেলো দুই পক্ষই একই পথের পথিক! সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। ‘অগত্যা হো হো হো হো।’
‘ই–ফেইল টাওয়ার’ এ গ্রন্থের আরেকটি চমৎকার রচনা। এক শীতের বিকেলে লেখকের সৌভাগ্য হলো ই–ফেল টাওয়ার দেখার। লেখকের খুব শখ জাগলো টাওয়ারের চূড়ায় উঠে প্যারিস শহরকে একবার দেখার। উঠতে গিয়ে দেখলেন লেখা আছে ‘হয় লিফটে উঠুন, না হয় পায়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে উঠুন।’ লিফটে উঠতে গেলে টিকেট কাটতে হবে। পয়সা বাঁচানোর জন্য লেখক দ্বিতীয় পন্থাই বেছে নিলেন। কিন্তু কিছুদূর ওঠার পর পায়ের ব্যথায় কাতর হয়ে লেখক ভাবলেন এবার লিফটে ওঠা যাক। তারপরের অভিজ্ঞতা লেখকের মুখেই শুনুন ‘লিফট এলো। দরজা খুললো। লিফটে ঢুকলাম। দরজা বন্ধ হলো। লিফট চলতে আরম্ভ করলো। এক মিনিট গেলো। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। লিফট দাঁড়ালো। দরজা খুললো। সামনে বের হয়েই দেখি টিকিট ঘর।’ অর্থাৎ টিকেট না কেটে ফাঁকি দিয়ে মধ্যখান থেকে লিফটে উঠে লেখক চেয়েছিলেন ওদের বোকা বানাতে। কিন্তু লিফট লেখককে নিচে নামিয়ে টিকেট কাউন্টারের সামনে হাজির করে চরম বোকা বানালো এবং অর্ধেক মূল্যের টিকেটও কাটালো। তারপর লেখকের দীর্ঘশ্বাসমিশ্রিত উক্তি ‘মাটির উপর দাঁড়িয়ে দূর থেকে আবার ইফেল টাওয়ারের চূড়া দেখলাম। ইফেল টাওয়ারের চূড়ায় উঠে অ–নে–ক নিচে প্যারিস শহরকে আর দেখা হলো না।’
এভাবে ষোলটি রম্যরচনায় লেখক আবদুল মালেক কখনো সরাসরি, কখনো পরোক্ষভাবে আমাদের রসবোধকে সূক্ষ্মভাবে উসকে দিয়েছেন। তাঁর এ রচনাগুলো পাঠকালীন পাঠক তার ঠৌঁটের কোণে হাসি ধরে রাখবেই। কোনোরূপ চটুলতার আশ্রয় না নিয়ে, কোনোরূপ বাগাড়ম্বর না করে কীভাবে সমাজের ছোটখাটো কিংবা বড় কোনো ত্রুটিকে সর্বজনের দৃষ্টির গোচরে আনা যায় লেখক এ গ্রন্থে তার চমৎকার দৃষ্টান্ত রেখেছেন। আমরা আশা করবো লেখক আবদুল মালেক তাঁর সহজাত রসবোধ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের রম্যরচনার ধারাকে সমৃদ্ধ করবেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ।