ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যের কারণে সাধারণ ভোক্তারা প্রায় দিশেহারা। করোনার কারণে দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ এমনিতেই বিপর্যস্ত। অনেকেই হয়ে পড়েছে কর্মহীন। কেউ কেউ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। গত আগস্ট মাসে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর গবেষণায় উঠে এসেছে- করোনাকালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ১৫ বছর আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারে। ২০০৫ সালে বাংলাদেশে এ হার ছিল ৪০ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, দেশের ৪০টি জেলার দারিদ্র্যের হার জাতীয় হারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। বৈশ্বিক মহামারী কম-বেশি সব পেশার মানুষকেই অস্থির করে তুলেছে। এ অবস্থায় সবার প্রত্যাশা ছিল, এবার অন্তত বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকবে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের কারসাজিতে লাগামহীন হয়ে পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজার।
গত ১৯ মার্চ দৈনিক আজাদীতে ‘রমজানের আগেই অস্থির বাজার, বেড়েই চলেছে প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দাম’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রমজান শুরু না হতে বেড়েই চলেছে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম। তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকেই দাম নির্ধারণ করে দিতে হয়েছে। তেল ছাড়াও ডাল, সাদা মটর ও রমজানের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছোলার বাজার বাড়তি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি। তবে ভোক্তারা বলছেন, প্রতিবছর রমজান এলে ব্যবসায়ীরা একেক অজুহাতে দাম বৃদ্ধি করেন। তাই অনেক ভোক্তা প্রশ্ন রাখছেন, ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাবে কে?
ভোজ্য তেল, চিনি, পেঁয়াজের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম মাঝে মধ্যেই অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এসব পণ্যে আমদানি নির্ভরতা থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারের দামের উঠানামা দ্রুত প্রভাব ফেলে স্থানীয় বাজারে। মাঝে মধ্যেই এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণের এসব পণ্যের সরবরাহ চেইন কার্যকরভাবে মনিটরিং এর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে বর্তমানে কিছু অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে স্থানীয় বাজারেও মূল্য বাড়ছে। তবে কোনো কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পেলে বা দেশীয় উৎপাদন ব্যাহত হলে বা বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে এবং তা যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এসব পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের পণ্য বিপণন মনিটরিং কমিটিসমূহের কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। সামনে রমজান মাস থাকায় কমিটি গঠন ও এর কার্যক্রমকে চালু করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
এছাড়া সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রমজান এলেই প্রতি বছর বেশ কিছু ভোগ্যপণ্যের দামে অস্থিরতা তৈরি হয়। এর একটি বড় কারণ থাকে ডি ও (ডেলিভারী অর্ডার) স্লিপ নিয়ে বাণিজ্য। সারাদেশে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী আছে যারা রমজানের আগে মিল থেকে ডেলিভারী অর্ডার নিয়ে পণ্য সংগ্রহ করে না। অন্য ব্যবসায়ীর কাছে বাড়তি দামে পুনরায় স্লিপ বিক্রি করে দেয়। এভাবে হাতবদলে পণ্যের দামও বেড়ে যায়। অথচ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ, ২০১১ তে ডি ও প্রথা বাতিল করে এস ও (সাপ্লাই অর্ডার) চালু করা হয়েছে। যেখানে ১৫ দিনের মধ্যে পণ্যের ডেলিভারী নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু এখনো সেই স্লিপ বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। ডি ও স্লিপ হাতবদল বন্ধে মনিটরিং করবে এসব কমিটি।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়তই বলা হচ্ছে, তারা বাজার তদারকি অব্যাহত রেখেছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, অব্যাহতভাবে বাজার তদারকির সুফল ভোক্তারা পাচ্ছে না কেন? করোনাকালে দেশব্যাপী নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। বিশেষ করে গত বেশ কয়েক মাস ধরে নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতির পাগলা ঘোড়া কোনোভাবেই বশ মানছে না। পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কার্যত তা কোনো কাজেই আসছে না। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রায় আর্থিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে, সেহেতু সেই চাপ যাতে আর না বাড়ে তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাপনে যেন কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয়, তার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এর পাশাপাশি অবশ্যই বাজারে নিময়িত নজরদারি নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো না হয়।