রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা

ডেইজী মউদুদ | শনিবার , ৯ আগস্ট, ২০২৫ at ১১:২০ পূর্বাহ্ণ

সীমা আর অসীমের তত্ত্ব চেতনায় ভাসতে ভাসতেই রবীন্দ্রনাথের কাব্যতরী বরাবর ছিল দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের দোলাচলে। অসীমের সাথে সীমাকে এক করার বাসনায় অনুসন্ধানী কবিমন ছিল চরম রোমান্টিসিজম আর কল্পনায় ভরা। সেই শিশু বয়সে অর্থাৎ মাত্র ৭/৮ বছর বয়সে জানালার কপাট দিয়ে বৃষ্টির জল দেখেই তিনি লিখেছিলেন,‘জল পড়ে, পাতা নড়ে/ পাগলা হাতি মাথা নাড়ে’। সেই শিশুতোষ ভাবনা কিশোর কবিকে ক্রমাগত কল্পনার জগতে এগিয়ে নিয়ে যায়। ফলে ‘কড়ি ও কোমল’ থেকে শুরু করে একেবারেই শেষ কাব্যগ্রন্থ পর্যন্ত তিনি একবার কল্পনার পাখায় ভর করে সীমার মাঝে থেকে অসীমের সন্ধান করেছেন, আবার যখন সেই ঘোর কেটে যায়, তখন তিনি পুনরায় মর্ত্যলোকে ফিরে এসে জীবন ও জগতের অমৃতসুধা পান করেছেন। কল্পনা আর বাস্তবতার এই পরিভ্রমণে কবির অন্তর্চিত্তকে পরিচালনাকারীকে কবি জীবনদেবতা নামে অভিষিক্ত করেছেন। তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘এ চির জীবন তাই/ আর কোন কাজ নাই / রচি শুধু অসীমের সীমা। আশা দিয়ে ভাষা দিয়ে / তাহে ভালোবাসা দিয়ে/ গড়ে তুলি মানসী প্রতিমা।’ এই মানসী প্রতিমা কবির মানস চেতনায় সদা বিরাজমান ছিল। বাস্তবে তার উপস্থিতি খুবই ক্ষীণ, কিন্তু কল্পনায় সেই মানস প্রতিমা অসম্ভব শক্তিশালী। ফলে কবি বারে বারেই সেই অধরা মাধুরীর স্পর্শ পাওয়ার সাধনায় ছিলেন মগ্ন। ‘সোনার তরী’ কবিতায় সেই তরী কবির কাছেই এসেছিলেন। কবি কি খুশি। তিনি বলেছিলেন ‘গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে? দেখে যেনো মনে হয় চিনি উহারে’ তাই কবি ডেকেছিলেন। তরীও এসেছিল। সোনার ধান দিয়ে কবি তরী ভরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এখন আমারে লহ করুণা করে ‘কিন্তু উত্তরে বললো ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী/ আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি/ শ্রাবণগগণ ঘিরে/ ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে/ শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি/ যাহা ছিল নিয়ে গেলো সোনার তরী। আবার ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় কবি যাত্রা করেই বলেন ‘আর কত দূরে, নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী/ বলো কোন পার ভিড়িবে তোমার সোনার তরী। যখনি সুধাই ওগো বিদেশিনী/ তুমি হাস শুধু মধুর হাসিনী/ বুঝিতে না পারি কি জানি কি আছে তোমার মনে’।

এর পরেও কবি এই মধুর হাসিনীর সাথে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিলেন। অকূল সমুদ্র পাড়ি দিয়েও বিন্দুমাত্র, বুঝতে পারেননি তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কেই বা তাঁকে নিয়ে যাচ্ছেন। এর পরেও অসীমের পানে যাত্রা, অন্তর মাঝে নিত্য বিচরণ সেই স্বপন চারিণীকেই তিনি কাছে পেতে চেয়েছিলেন বারে বারে। চিত্রা কাব্যের ‘অন্তর্যামী’ কবিতায় তিনি বলছেন একই কথা ‘অন্তর মাঝে বসি অহরহ/ মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ/ মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ মিশায়ে আপন সুরে’। আসলে কবি এই মানবীর প্রত্যাশায় বারবার ছুটে যান। অনর্গল কথা বলেন কবিতার ছন্দে, নব নব আনন্দে। কিন্তু যেখানেই ছুটে যান না কেনো, যতই বিভোর থাকেন না কেন, কিন্তু ধরতে পারেন না সেই রহস্যময়ীকে। তাই বলেন, ‘জগতের মাঝে তুমি যে বিচিত্র, হে বিচিত্ররূপিনী!’ ‘স্বপ্ন’ কবিতায় তিনি বলেছেন ‘দূরে, বহু দূরে, স্বপ্নলোকের উজ্জ্বয়িনী পুরে, খুঁজিতে গেছিনু তারে শিপ্রা নদীতীরে, মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে।’ এরপরেও কি খুঁজে পেয়েছিলেন? না, পাননি। এরপরেও এর পিছু পিছু যাত্রা আর কল্পনার শেষ নেই কবির। তাই ‘সিন্ধুপারে’ কবিতায় তিনি আবারো কোন এক শীতের গভীর রাতে অবগুণ্ঠনধারিণী এক অশ্বারোহী রমণীর নির্দেশে আবার যাত্রা করলেন সেই রহস্যময়ীর সাথে মিলনের উদ্দেশ্যে। নিশীথ রাতে ছুটতে ছুটতেই রজনী প্রায় শেষ। এক নির্জন গুহামুখে অশ্বারোহী এসে থামলো। কবিও চলেন তার পিছু পিছু। দীর্ঘগুহায় অন্ধকার পথে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা একের পর এক ঘটে যাচ্ছিল।

কি সুন্দর নীরব নিস্তব্ধ এক রাজপুরীতে কবি। মনি মুক্তারত্নখচিত সাজানো থরে বিথরে। কবির সাথে এই রমণীর বিয়ের রাজকীয় আয়োজন যেনো রাজপুরী জুড়ে। বৃদ্ধ পুরোহিত বলেন লগ্নের সময় এখন। নানাবিধ চক্র এঁকে, রাশি গুণে মন্ত্র পাঠও হলো। অপেক্ষা কেবল রহস্যময়ীর নির্দেশের। রত্নখছিত সোনার পালঙ্কে রমণী বসলেন। কবিকেও বসালেন। চারিদিকে সারি সারি অপরূপ সুন্দরী নারীকুল দাঁড়িয়ে মঙ্গলদ্বীপ হাতে। কি অসাধারণ সে রূপ আর চিত্রকল্প। ধূপ রাশি, উলু আর শঙ্খ ধ্বনিতেই শেষ হলো মন্ত্র পাঠ! শুভ দৃষ্টি বিনিময় সমাসন্ন। কবি বলেন, ‘আমি কহিলাম সব হেরিলাম, তোমারে দেখিনি শুধু! এই সময়ে হঠাৎ রাজপুরীতে ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠলো, নির্জন নীরব পুরী কোলাহল মুখর হলো, রমণীর কলকল হাস্যধ্বনিতে কবি স্তম্ভিত হলেন। হঠাৎ ধীরে অতি ধীরে রমণী যখন অবগুণ্ঠন খুললেন, তখন কবি থর থর করে যেনো কেঁপে উঠে দেখলেন এতো কোনো সাধারণ মানবী নয়। এতো এক দেবী, জীবনের চালিকাশক্তি।

কবি তখন লিখলেন ‘চকিত নয়ানে হেরি মুখ পানে পড়িনু চরণতলে/এখানেও তুমি জীবনদেবতা কহিনু নয়ন জলে/ সেই মধুমুখ, সেই মৃদুহাসি, সেই সুধা ভরা আঁখি/ চিরদিন মোরে কাঁদালো হাসালো চিরদিন দিল ফাঁকি। আসলে কবির জীবনদেবতা শুধু জীবনদেবতা নয়, জীবনরূপেরই দেবতা। যে দেবতা জীবনের সূচনাপর্ব থেকেই আমৃত্যুই কবিচিত্তকে পরিচালনা করেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজনগণের ভোটে তারেক রহমান হবেন আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধমধ্যবয়সের ভালোবাসা: দুর্বলতা নয়, নতুন শুরু