বিশ্ব-সংগীতলোকে শ্রেষ্ঠ দুই জ্যোতিষ্ক -গীতিকার রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’, ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’- এই দুই রবীন্দ্রসংগীত এবং ‘দূর দ্বীপ-বাসিনী চিনি তোমারে চিনি’, ‘রাঙা মাটির পথে লো’- নজরুল গীতিদ্বয় বহুশ্রুত বাংলা গানের মর্যাদায় অভিষিক্ত। রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুল গীতিতে পাওয়া এরকম সাদৃশ্য ভাবনাযুক্ত কথার মিল লক্ষ্য করে মনে দানা বাঁধে তত্ত্ব-কথা পুরাণ।
নিবিড় কান পেতে ‘বাংলাদেশ বেতার’ এবং ‘আকাশবাণী’ হতে সম্প্রচারিত বিশেষ গানের অনুষ্ঠানে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষারত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের আবহে রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুলগীতি ভাণ্ডারের গান শোনার রেশ শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের ঘোরে এখনো যেন লেগে আছে। কখনো আবার এইসব প্রিয় গান বিভিন্ন প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের মধ্যে কোন্ নির্দিষ্ট শিল্পীর কণ্ঠে সবিশেষ প্রস্ফুটিত, উজ্জ্বলতর, আবেগায়িত, তার তালিকা সাজিয়ে রাখতাম। যেমন-রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে’-হেমন্ত, ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন’-কলিম শরাফী, ‘তুমি কি কেবলি ছবি’- শান্তিদেব ঘোষ ইত্যাদি। তেমনিভাবে- নজরুল গীতিতে ‘ মধুর বাঁশরী বাজে’- মহম্মদ রফি, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’- মানবেন্দ্র, ‘ওগো প্রিয় তব গান’- ফিরোজা বেগম প্রভৃতি। পরে এভাবে লিপিবদ্ধ নোট দেখে ক্যাসেট তৈরির পাগলামো চেপে বসেছিলো মাথায়।
শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে কিছু পড়াশোনা এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষা উত্তীর্ণ হবার সুবাদে এই বিষয়টা নিয়ে কিছু বলতে-লিখতে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে তবু কিছু সাহস থাকে। কিন্তু তার বাইরে মনোজগতের সঙ্গী যেমন-গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়া-কিশোর কবিতা সাহিত্য পরিমণ্ডলের বিভিন্ন শাখায় তেমন গভীরতর আহরণ বা চর্চা না থাকাতে, এ সম্পর্কিত কোনো সিদ্ধান্তের জানান দিতে কেমন যেন সংশয়াচ্ছন্ন ও সংকোচের বিহ্বলতায় আবৃত থাকতে হয়।
একবার প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী আয়েশা হক শিমুর সঙ্গে সাক্ষাতে ‘রবীন্দ্রনাথকে কে বেশি রীড্ করেছিলেন’ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসি। তিনি স্মিত হেসে তাৎক্ষণিক জবাব দেন-‘নজরুল’। প্রশ্নোত্তর ফাঁস হয়নি, তবুও আমার এতদিনকার সূত্র কেমনে জেনে গেলেন তিনি-ভেবে অবাক হলাম, খুশিও হলাম।
হিসাব করে দেখা, রবীন্দ্রনাথের প্রায় আটত্রিশ বছর পরে নজরুলের এবং নজরুলের প্রায় বিশ বছর পরে বঙ্গবন্ধুর জন্ম। এই তিন মহামানবের আবির্ভাব ধারাবাহিকতার প্রভাব বলয়ে নির্মিত আজকের বাঙালি ও বাংলাদেশ। তাঁরা কে কাকে কখন দেখেছেন, একজনের মানস চৈতন্যে অন্যজনের কতটা প্রভাব তা বিস্তৃতভাবে চিন্তা করা যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের কিছু পারস্পরিক সাক্ষাৎপর্বের কথা আমরা জানি। শোনা যায় নজরুল নিজে রবীন্দ্রসংগীত করতেন, এমনকি শিল্প মাধ্যমে কোন একবার নজরুলের রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার করা নিয়ে দুষ্টজনেরা কবিগুরুকে কানভারী করা পরামর্শ দিলে গুরুদেব নজরুলকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে এরকম বলেছিলেন- রবীন্দ্রনাথের গান নজরুল ছাড়া আর ভালো কে বুঝবে।
প্রেম কিংবা প্রকৃতি পর্বের গান রচনার বিষয়-বৈচিত্র্যে একই বোধে অনুরক্ত হতে পারেন যে কোনো সময়ের কবি বা গীতিকার। পরে নিজস্ব বৈভবে বিমূর্ত হয় আপন সৃষ্টি। সংগীত নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের মহাসাগর সম জ্ঞান তাঁদের এই সক্ষমতা এনে দিয়েছে। খুঁজলে হয়তো উল্লিখিত গীতিকবিতার মতো রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের পারস্পরিক ভাবনাযুক্ত অনেক গানের হদিশ মিলবে। সেসব গান রচনার সময়কাল এবং প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষণার আলো ফেলা হলে পুরো তথ্যচিত্রে তা ধরা দিতে পারে।
মনে হয় আবহমান বাঙালির ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং বঙ্গবন্ধুর আগমন রাশি যোগ যেন পূর্বনির্ধারিত। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নজরুলের উল্লেখ পাই। বিদ্রোহী কবিকে জাতীয় কবির মর্যাদায় আসীন করানো, বিশ্বকবির ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত রূপে নির্বাচন এবং বিভিন্ন সভা-সমাবেশে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণাদায়ী কথামালার উদ্ধৃতি এই ধারণা দেয় যে, বাঙালি জাতির পিতা তাঁর এই দুই পূর্বসূরি মহামানবের চিত্তে-মর্মে কত গভীরভাবে প্রবেশ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং বঙ্গবন্ধু নিয়ে সামান্য যেটুকু বিদ্যা অর্জিত হয়েছে, তাতে কেন জানি এই তত্ত্বকথাটা মনে গেঁথে গেল- রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে বেশি রীড্ বা অনুধাবন করেছেন নজরুল, আর রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে মননে সর্বাধিক রীড্ বা ধারণ করেছেন বঙ্গবন্ধু। হয়তো এই মন-ভাবনা থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা গানে কয়েকটি চরণে লিখেছিলাম- ‘তুমি রবীন্দ্রনাথ তুমি নজরুল/ দু’জনের দীক্ষায় ফোটা সেরা ফুল/ বাঙালি কোনদিন ফিরে পাবে না’।