শিক্ষা জাতি গঠনের শুধু মূল স্তম্ভই নয়, শিক্ষার মাধ্যমে একটি জাতি উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়। একটি রাষ্ট্রে বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেণি ও নারী–পুরুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়লে দেশ অগ্রগতি, উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একসময় বাঙালি নারী সমাজ শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। শিক্ষাদীক্ষা বাইরের পরিবর্তিত দুনিয়ার সঙ্গে তাদের কোনো পরিচয় ছিল না। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া তাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসার পথ দেখালেন। তিনি যে নারী শিক্ষার আলো প্রজ্বলিত করেন; সেই আলোয় আলোকিত হলো নারী সমাজ। সব বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম করে নারী সমাজ শিক্ষাগ্রহণে ব্রতী হয়ে এক নতুন যুগের সূচনা করে। তাই বর্তমান নারী সমাজ শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছে। আজ নারী সমাজ অন্ধ অনুকরণ থেকে মুক্ত। সব ধরনের জড়তা, কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সত্তা ও একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠার নিরন্তন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এ সংগ্রামে তারা অনেকটাই জয়ী। শিক্ষার আলোই তাদের এই পথ দেখিয়েছে। শিক্ষাই তাদের পৌঁছে দিচ্ছে সাফল্যের সুউচ্চ শিখরে। আজ নারী বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে আপন মহিমায় ভাস্বর। তাই নারী আজ ঘরের কোণে সেকালের মতো বন্দি থেকে অন্ধ অনুকরণ ও বিশ্বাসকে আঁকড়ে না ধরে শিক্ষা তাদের অন্তর–বাহিরকে জাগরিত করেছে। তাই এ কথা আজ বলতে দ্বিধা নেই যে, শিক্ষা ছাড়া নারী সমাজের পরিবর্তন সম্ভবপর ছিল না। কারণ শিক্ষা শুধু একটি জাতি গঠনের মূল স্তম্ভই নয়, বরং জাতির বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত করে। দেশ উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়। যুগে যুগে নারী–পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে গেছে সমৃদ্ধির পথে। আজকে আমাদের নারীর অগ্রগতি আমাদের আশান্বিত করে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু পুরুষ নয়, নারীর অগ্রগতি এগিয়ে চলা দৃশ্যমান। এ পথে নারীর নানা বাধাবিপত্তি থাকলেও শিক্ষা চাকরি নারীর ক্ষমতায়নসহ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জিং পেশায় থেকে দেশ জাতির উন্নতি, অগ্রগতিতে কাজ করে যাচ্ছে।
বেগম রোকেয়া যে নারী জাতির অগ্রগতি, উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন, তা আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। এগিয়ে চলেছে নারী, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, বর্তমান সমাজে নারী সেকালের বৃত্তের মধ্যে বন্দি নেই। সমাজ ব্যবস্থার আরোপিত শৃঙ্খল ভেঙে আত্মবিশ্বাসে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই নারী শুধু ঘরেই নয়, এমন সব কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থেকে তাদের আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রগামিতায় সিংহভাগ মানুষের অংশগ্রহণ একটি অপরিহার্য বিষয়। অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং পিছিয়ে পড়া নারীরা আজ বিভিন্নভাবে সামনের দিকে চলে আসাটা এক পরম স্বস্তির ব্যাপার। বাংলাদেশের নারীরা এখনও পশ্চাৎপদ সামাজিক অপসংস্কারে নিজেদের চলার পথকে সেভাবে নিঃসংশয় এবং নির্বিঘ্ন করতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক অভিশাপ ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। সব বাধা বিঘ্নকে পেছনে ফেলে নারীরা এগিয়েও যায় সাবলীল গতি এবং নিজেদের অসম সাহসিকতায়। নারীদের ক্রমশই এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য বিমুগ্ধ হওয়ারই মতো। আগে শিক্ষকতা ও চিকিৎসক হিসেবে মেয়েরা কর্মজীবন শুরু করতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। কিন্তু সময়ের অনিবার্য চাহিদায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদায় তাদের অভিষিক্ত হওয়াও এক অভাবনীয় নির্দেশনা। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সচিব মর্যাদায় নিজেদের অংশীদারিত্ব তাই প্রমাণ করে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে আসীন হতেও তারা এগিয়ে যাচ্ছে। সাহিত্য সংস্কৃতির জগতের সাথে নিজেদের সংশ্লিষ্ট করে অনন্য সাধারণ ভুমিকা রেখে চলছে। আর উদ্যোক্তা তৈরিতে নারীর অপার সম্ভাবনা দৃষ্টিনন্দন। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার ভূমিকায় নামতে তারা এখন সরকারি–বেসরকারি ঋণ সুবিধা পেতেও সমস্যায় পড়ছে না। ব্যবসায়িক ঝুঁকিতে নারীদের অনিচ্ছা এবং অস্বস্তি এখন আর সেভাবে কাজ করছে না। নিজের প্রবল ইচ্ছা আর অনন্য মনোশক্তিতে যে কোনও ব্যবসায়িক কাজকর্মকে তারা সাবলীলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর তথ্য প্রযুক্িতর আলোকিত ভুবনে দেশের নারীরা যেভাবে নিজেদের দক্ষতা ও পারদর্শিতা প্রদর্শন করে যাচ্ছে সেখানেও তাদের জোরালো ভূমিকা অনন্য বাংলাদেশ তৈরির মহাকর্মযজ্ঞ, যা অর্থনীতির সমৃদ্ধ খাতকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে দিচ্ছে। রফতানি শিল্পে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ বিশ্বে নজরকাড়া। পোশাক শিল্প খাতে বাংলাদেশে রফতানি আয়ের সিংহভাগ অর্জিত হয়। পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি–সেটা সবারই জানা। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে ভূমির উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ এক অপরিহার্য বিষয়। ধানের বীজ রোপা থেকে জমির পরিচর্যা ছাড়াও ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত নারীদের সমান অংশীদারিত্ব সত্যিই দেশের জন্য অপার সম্ভাবনা। প্রচলিত সমাজের স্বাভাবিক জীবন ধারায় নারীরা সব সময় নিরবচ্ছিন্ন গতিতে এগিয়ে যায় তাও কিন্তু নয়। পুরনো ঐতিহ্যিক সমাজ আধুনিক সময়কে সেভাবে অবারিত হতে দেয় না। বাধা, প্রতিবন্ধকতা সামলে নিয়ে নারীদের এগিয়ে চলা তাও এক কঠিন যাত্রাপথ। পুরনো সংস্কারের ভিত্তিকে অত সহজে নাড়ানো যায় না। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ সমপ্রসারণে যান্ত্রিক সভ্যতাকে আয়ত্বে আনা গেলেও মানস সংস্কৃতিকে পাল্টানো তত সহজ নয়। কারণ দীর্ঘদিনের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, জীবনাচরণ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে ডিঙাতে গেলে অপেক্ষার অন্ত থাকে না। ততদিনে যা হওয়ার তাই ঘটে যায়। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। কবি নজরুলের এ মহান বানীটির অর্থ হলো জেন্ডার বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে নারীর অগ্রগতি দেশের উন্নয়ন। মোটা দাগে বলা যায়, নারী–পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি দেশের উন্নয়ন ঘটে। বর্তমান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই নারী পুরুষের যৌথভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলে দেশে গণতন্ত্র উন্নয়ন, সুসংহত হবে; তেমনি সুশাসন দৃঢ় হবে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নারী আর পিছিয়ে নেই, নারীর অগ্রগতির পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। একসময় বাংলাদেশের প্রশাসনে নারীর পদচারণা তেমন লক্ষ করা যায়নি। দেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যাযে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধি আইন তৈরিসহ বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। অপরদিকে স্থানীয় পর্যায়ে নারী এলাকার উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখছেন। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পরিষদে সরাসরি গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নারী সদস্যের সরব উপস্থিতিই প্রমাণ করে পুরুষের মতো নারীর অগ্রগতি হয়েছে। এটা শুধু কথার কথা নয়। বাস্তব ও দৃশ্যমান।
নারীশিক্ষায় দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ৫০ শতাংশ নারী। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীর সংখ্যা ৫৩ শতাংশ। সরকারি বেসরকারি চাকরির পাশাপাশি কৃষি–শিল্পসহ সামরিক, বেসামরিক প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। সাংবাদিকতা হিসেবেও নারী সাহসী ভূমিকা পালন করছেন। তা ছাড়া জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বিচারপতি, পাইলটসহ রাষ্ট্রের ঝুঁকিপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর উপস্থিতি লক্ষণীয়।
নারীর অগ্রগতির ক্ষেত্রে কিছু বাধা ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এখনো নারী নির্যাতন বন্ধ হয়নি। তাদের পথচলা সুগম হয়নি। ঘরে–বাইরে তারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। অথচ নারীরা আজ ঘরে–বাইরে সর্বত্র কাজ করছেন পুরুষের চেয়ে বেশি। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। ফলে অনেক নারী নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষমতা অর্জন করছেন। জয় হোক নারীর। জয় হোক বাংলাদেশের। জয় হোক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
লেখক : কবি, গল্পকার