যেরকম দৃষ্টি সেরকম সৃষ্টি

ড. আবদুল আজিম শাহ | মঙ্গলবার , ৩ অক্টোবর, ২০২৩ at ৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহ রব্বুল আলামিন সমগ্র সৃষ্টির মালিক। মানব হলো সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ উপহার। সমগ্র সৃষ্টিজুড়ে আল্লাহর অস্তিত্ব বিদ্যমান। অপরদিকে মানবের মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব এবং সত্তা দুটোই বিদ্যমান। অর্থাৎ মানবের মধ্যে মহাত্মার অংশ আত্মা বিরাজিত। এমনকি সমগ্র প্রকৃতিও মানবদেহে রয়েছে। এজন্য বলা হয়যাহা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, সব আছে দেহভান্ডে। শুধু তাই নয় এমনকি স্রস্টাও মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। এইজন্য আল্লাহ বলেন, ‘আল ইনসানু ছেররি ওয়া আনা ছেররুহু’ অর্থাৎ মানব আমার রহস্য, আমি মানবের রহস্য। আল্লাহর আধ্যাত্মিক শক্তিও মানবের মধ্যে সুপ্তভাবে নিহিত। আছে প্রজ্ঞানের শক্তি। তার মধ্যে আছে বিবেক, আছে চেতনা, যার দ্বারা মানুষ সত্যমিথ্যার পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে। আছে অনুভূতিযা দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে। তাই মানব হলো আশরাফুল মাখলুকাত। সাধনার মাধ্যমে মানব অন্তরে আধ্যাত্মিক শক্তিকে জাগ্রত করে একদিকে আল্লাহর জ্ঞানে মহাজ্ঞানী, রূপগুণে গুণান্বিতসহ রঙে রঞ্জিত হওয়া যায়। এর জন্য প্রয়োজন সুবুদ্ধির চর্চা। অপরদিকে এই সৃষ্টির সেরা মানুষ কুবুদ্ধির চর্চা দ্বারা সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে। এবং সম্পূর্ণ শয়তানের চরিত্র ধারণ করে। তার দ্বারা সমাজে অকল্যাণ হয়। কারণ মানব সুবুদ্ধি ও কুবুদ্ধি দুটোই ধারণ করে। হযরত জালাল উদ্দিন রুমি(রহ.) তাঁর ‘ফিহি মা ফিহি’ গ্রন্থে বলেছেন, “মানুষ অর্ধেক ফেরেস্তাসম, অর্ধেক পশুসম”। আরো বলেছেন, “মানুষ অর্ধেক মাছ, আর অর্ধেক সাপ। মাছ অংশ তাকে জলের দিকে আর সাপ অংশ বালির দিকে নিয়ে যায়। তারা সব সময় এই যুদ্ধে লিপ্ত আছে।” জল জ্ঞানকে বৃদ্ধি করে। ব্যক্তিত্বকে নির্মাণ করে, মানবকে বিনয়ী করে। কারণ পানির মধ্যে ইয়াং ক্যাটালাইটিক এজেন্ট (অর্থবিশ্বসৃষ্টির সক্রিয় মূল পুরুষ উপাদান, যা অদৃশ্যভাবে কাজ করে) থাকে । পানির সংস্পর্শ মানুষকে স্রষ্টামুখী করে। এজন্য আল্লাহর আউলিয়াদেরকে অধিকাংশ সময় পানিতে অবস্থান কিংবা বসে থাকতে দেখা যায়। অপরদিকে সাপ মানুষকে বিপথগামী করে। মাওলানা রুমি আরো বলেন, “ফেরেশতারা মুক্ত তাঁর জ্ঞানের জন্য, পশুরা মুক্ত তাদের অজ্ঞতার জন্য। দুইয়ের মাঝে মানব সন্তান সংগ্রামে লিপ্ত”। সুবুদ্ধি ও কুবুদ্ধির সংমিশ্রণে মানব। সুবুদ্ধির চর্চা ও দৃষ্টিভঙ্গি কালজয়ী শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিনত করে। এই চর্চা দ্বারা প্রতিটি কর্মে, চিন্তায়, ইতিবাচকতা পরিলক্ষিত হয়। এবং প্রকৃতির দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান সবকিছুই ইতিবাচকরূপে ধরা দেয়। এমন কি সৃষ্টির অধিপতি মহান আল্লাহকেও পাওয়া যায়। আর কুবুদ্ধির চর্চা মানুষকে ধ্বংস করে। একটি ঘটনাকে কেউ নেতিবাচক আবার কেউ ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। ঘটনা কিংবা কর্ম একই হলেও কেউ ইতিবাচক কর্মে নেতিবাচকতা খুঁজে পায় আবার অনেকেই নেতিবাচক কর্মের মধ্যেও ইতিবাচকতা খুঁজে পান। অর্থাৎ ভালোমন্দ, ঠিকবেঠিক নির্ভর করে দ্রষ্টার দৃষ্টির উপর। প্রখ্যাত জাপানি বিজ্ঞানী মরিসো ইমোতো বস্তুর ওপর চিন্তার প্রভাব (যাকে বলে ঃযড়ঁমযঃ বভভবপঃ সধঃঃবৎ) সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে নমুনা হিসেবে পানিকে পরীক্ষা করেন। তিনি একই নমুনার পানি পৃথকভাবে দুটি বোতলে রাখেন। প্রথম বোতলের পানিকে বলতে থাকেনতুমি খুবই উপকারী, তুমি মানুষের জীবন বাঁচাও, তোমাকে ধন্যবাদ। এরপর অপর বোতলের পানিকে বলেনতুমি খুবই খারাপ, তোমার কারণে ডায়রিয়া হয়ে মানুষ মারা যায়। এই দুই বোতলের পানিকে ক্রিস্টালাইজ (-৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রায়) ও মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করে দেখলেন দুই বোতলের পানির বিন্যাস ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানানো পানির অণুগুলো ফুলের মত সুশৃংখল আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে বিরক্তি প্রকাশ ও হুমকি দেওয়া পানির অণুসমূহ বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো বিন্যাসহীন রূপ ধারণ করেছে। এইজন্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এমন এক শক্তি যা দিয়ে সৃষ্টিকে জয় করা যায়। এর আত্মিক ভাইব্রেশন দ্বারা মানব মনে প্রভাব বিস্তার করা যায়। নেপোলিয়ন বলেছেন, “মানুষের মন যা ধারণ ও বিশ্বাস করে, সে সেটা অর্জন করে”। ইতিবাচকতা ধারণ করলে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়া যায়। যেহেতু স্রষ্টা সৃষ্টির কারক তিনি সৃষ্টি করেন; তদ্রুপ ইতিবাচক গুণে গুণান্বিত হয়ে সেও সৃজন করতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানও সেটা স্বীকার করে। বিজ্ঞানের মাধ্যমে এটিকে সহজে ব্যাখ্যা করা যায়। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ থিউরি -‘কোয়ান্টাম ম্যাকানিকস থিওরি’। এটি হলো ‘সকল পদার্থ তরঙ্গ ও কণা উভয় রূপ আচরণ করে’। অর্থাৎ কোনও সময় কণা আবার কোনও সময় তরঙ্গ রূপ আচরণ করে। কিন্তু কখন কণা কিংবা কখন তরঙ্গ রূপ আচরণ করে তা সহজে কেউ জানতে পারে না। অথবা বলা মুশকিল। আবার বিজ্ঞানী ডেবিড বোম অনেক পূর্বেই প্রমাণ করেছেন যে, ‘সকল বস্তুই গতিশীল’। প্রত্যেক বস্তুই অণুর সংযোগ। অণু হলো পরমাণুর সংযোগ। পরমাণু ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে গঠিত। যেমন পানির একটি বুদবুদের মধ্যে ৪২ থেকে ৪৬ টি অণু থাকে। একটি অণুতে মিলিয়ন বিলিয়ন পরমাণু থাকে। একটি পরমাণুকে ১০ লক্ষ ভাগে ভাগ করলে এক অংশকে বলে নাভি, যা নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত। নিউক্লিয়াসে ইলেকট্রন প্রোটন ও নিউট্রন থাকে। নিউক্লিয়াসের প্রতি সেকেন্ডে ৮৫ হাজার মাইল গতিতে ঘূর্ণিয়মান। যেহেতু এগুলো ঘূর্ণিয়মান অতএব এদের সংযোগে গঠিত অণুপরমাণু সবই ঘূর্ণিয়মান। পরমাণু সংযোগে অনু এবং সর্বশেষ অণুর সংযোগে গঠিত পানিসহ যেকোনো বস্তুই ঘূর্ণিয়মান কিংবা গতিশীল। অর্থাৎ সকল কিছু গতিশীল। প্রকৃতিতে স্থিতি বলতে কিছু নেই। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো সকল বস্তুকে আমরা স্থির দেখি। কারণআমরা যে চোখে দেখি, এই চোখের দৃষ্টিরও গতি আছে; অতএব চোখের গতিরও দৃষ্টিসীমা রয়েছে। এবং প্রত্যেক বস্তুর গতি আপেক্ষিক। চোখের দৃষ্টিসীমার গতির চেয়ে যখন বস্তুর গতি বেশি হয় তখন বস্তুকে স্থির দেখি। মূলত স্থির নয়। যদি সুবুদ্ধির চর্চা ও সাধনার মাধ্যমে বস্তুর গতির চেয়ে দৃষ্টির গতিকে বৃদ্ধি করা যায় তখন ওই বস্তুকে গতিশীল দেখা সম্ভব। আর এটি সম্ভব হয় অনুভূতি ও দিব্যদৃষ্টি দ্বারা। অনুভূতির মাধ্যমে বস্তুর গতিপ্রকৃতিসহ মূল প্রকৃতির দর্শন সম্ভব। একইভাবে বস্তুর মধ্যে মিলিয়ন বিলিয়ন তরঙ্গ চলমান থাকে। যখন দৃষ্টিসীমাকে অনুভূতির দ্বারা অসীম গতিতে নিয়ে বিলিয়ন তরঙ্গকে পর্যবেক্ষণসহ দৃষ্টি দেওয়া যায় তখন ওই তরঙ্গ কণাতে রূপান্তরিত হয়। তরঙ্গ কণারুপে ধরা দেয়। অর্থাৎ তরঙ্গ তখন কণারূপে আচরণ করে এবং আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। আর কণা থেকেই সৃষ্টি। বিজ্ঞান বলেতরঙ্গকে কণাতে পরিবর্তন করার জন্য দ্রষ্টার দৃষ্টি প্রয়োজন। এজন্য বলিযেরকম দৃষ্টি সেরকম সৃষ্টি।

দ্রষ্টার দৃষ্টি ব্যতীত সৃষ্টি করা যায় না। এই দৃষ্টিশক্তি অর্জনের জন্য প্রয়োজন আধ্যাত্মিক শক্তি, যাহা বেলায়েতের শক্তি নামে পরিচিত। মানবের মধ্যে লুকায়িত সুপ্ত আধ্যাত্মিক চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য সুবুদ্ধির চর্চা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আবশ্যক। তাইতো চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা মতি ভান্ডার দরবার শরীফের প্রখ্যাত সুফিসাধক হযরত মতিয়র রহমান শাহ (.) ফরহাদাবাদি সব সময় বলতেন– ‘সুবুদ্ধির পথে চলো’। সুবুদ্ধি কী জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে তিনি বলেন, সুবুদ্ধিতে খোদা, সুবুদ্ধিতে রাসুল(.), সুবুদ্ধিতে কোরআন, সুবুদ্ধিতে ইসলাম, সুবুদ্ধিতে ঈমান, সুবুদ্ধিতে মানবতা। সুবুদ্ধি ছাড়া কখনো আল্লাহকে পাওয়া যায় না, সে যত বড় সাধক হোন না কেন। সুবুদ্ধির মাধ্যমেই চেতনাকে জাগ্রত করা যায়। এই চেতনা হল অন্তআলোক শক্তি তথা বেলায়েতের শক্তি। বেলায়েতের শক্তি যিনি অর্জন করতে পারেন তখন তিনি স্থান, কাল, সময় ও জাগতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত হন। আউলিয়াগণের এই দৃষ্টিশক্তি আছে বলেই এঁরা সৃজন করতে পারেন এবং প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করেন। প্রখ্যাত সুফি সাধক হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ(.) মাইজভান্ডারীর এই দৃষ্টিশক্তি ছিল বলেই পুকুরে বদনা নিক্ষেপের মাধ্যমে ৩৭ মাইল দূরবর্তী রাঙ্গুনিয়ার কোদলা গ্রামে ভক্তকে বাঘের আক্রমণ হতে রক্ষা করেন। হযরত সৈয়দ গোলামুর রহমান(.) মাইজভান্ডারীর এই দৃষ্টিশক্তি ছিল বলেই চোখের পলকেই পাপিষ্ঠ বান্দাকেও আউলিয়ার মর্যাদা দান করেছেন। হযরত মতিয়র রহমান শাহ() ফরহাদাবাদির এই শক্তি ছিল বলেই পানির উপর হাঁটতেন এবং স্থান, কাল ও সময়ের ঊর্ধ্বে বিচরণ করতেন। এইজন্য একই সময়ে তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় দেখা যেত। শাহানশাহ হযরত জিয়াউল হক(.) মাইজভান্ডারীর এই দৃষ্টিশক্তি ছিল বলেই দৃষ্টির মাধ্যমে পানিশক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করেছেন অর্থাৎ তেল ব্যতীত পানি দিয়ে জীপ গাড়ী চালিয়েছেন। এগুলো সৃজনশীল গুণ। এদৃষ্টি যাঁরা অর্জন করেছেন অর্থাৎ যে বা যাঁরা তরঙ্গকে কণারূপে পরিবর্তন করতে পারেন, তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান, আদব, বিনয় প্রদর্শন করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

অনুরূপভাবে সমাজ, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা হল নিজের আয়না। কোনো ব্যক্তি প্রকৃতি ও পারিপার্শ্বিকতাকে যে দৃষ্টিতে দেখবেন, তারাও তার প্রতি একই দৃষ্টিতে তাকাবে। সমাজ পরিবর্তনের পূর্ব শর্ত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই দৃষ্টিভঙ্গির নাম সুবুদ্ধির দর্শন। প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনসহ সুবুদ্ধি ধারণ করলে সমাজ ও দেশ এমনিতেই পরিবর্তন হয়ে যাবে। সুবুদ্ধি ব্যতীত আত্মউন্নয়ন হয় না। এটি ব্যতীত পূর্ণ মানব হওয়া যায় না। পূর্ণমানব না হওয়া পর্যন্ত পরম বা অসীম দৃষ্টি অর্জিত হয় না। এবং সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না এই দৃষ্টি ব্যতীত সৃজন করা যায় না। সৃজনশীলতা আল্লাহর গুণ। যার মধ্যে এই গুণ নিহিত, তার দ্বারা কখনো সমাজের অকল্যান হয় না। বরং কল্যাণ বয়ে আনে। তাঁদের আত্মা ভালোবাসায় পূর্ণ।

এভাবে ব্যক্তি থেকে সমষ্টি পর্যায়সহ বিশ্বব্যাপী সুবুদ্ধির প্রচার যদি করা যায় এবং সুবুদ্ধি ধারণ করে তাহলে বিশ্ব থেকে হানাহানি, মারামারি, হিংসা, বিদ্বেষ, সকল ভেদাভেদ ভুলে কর্তৃত্বের দৃষ্টিতে নয় বরং সহমর্মিতার সাথে সকলে সহঅবস্থান করবে। বিশ্ব হবে একটি পরিবার। সকলেই হবে এই পরিবারের সদস্য। কেউ কারো মত ও পথের বিরোধী বা সাংঘর্ষিক হবে না। বরং অন্যের মত, পথ ও দর্শনকে সম্মান করবে। সুবুদ্ধির জয় হোক।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাসায়নিক শিল্পপার্ক ও প্লাস্টিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ১১.৪৭ কোটি টাকা