সেন্টমার্টিন ভৌগোলিক কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর গুরুত্ব নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সবাই স্বীকার করেন। দ্বীপটিতে অনেক জীববৈচিত্র্য রয়েছে; কিন্তু একশ্রেণীর মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কাজের কারণে দ্বীপটির পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে। সেখানে নির্বিচারে অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। নিশ্চিত করা যায়নি সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। পরিবেশবিদরা চান, যে কোনো মূল্যে সেন্টমার্টিনকে রক্ষা করতে হবে। সেখানে সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ ও সমপ্রসারণ বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বীপে যান চলাচলকে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। দ্বীপ রক্ষায় ম্যানগ্রোভ ও কেয়া বেষ্টনী বৃক্ষরোপণ করা জরুরি।
গত ৩১ মে দৈনিক আজাদীতে ‘সেন্টমার্টিন কেন ক্ষয়ে যাচ্ছে, প্রবালদ্বীপের অস্তিত্ব নিয়ে নতুন উদ্বেগ, দ্বীপ রক্ষায় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের আহ্বান’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ–প্রতিবেশ রক্ষায় নানা উদ্যোগের মধ্যে সমপ্রতি ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত এ প্রবালদ্বীপের অস্তিত্ব নিয়ে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজার উপকূল ছুঁয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র বাংলাদেশের উপর দিয়ে না গেলেও এবং ভাটার সময় ঝড় আঘাত হানায় জলোচ্ছ্বাস তেমন না হলেও প্রবালদ্বীপটির পশ্চিম পাড়া, পূর্ব পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, উত্তর পাড়া, নজরুল পাড়া, মাঝের পাড়া, ডেইল পাড়া, কোনার পাড়া ও গলাচিপা পাড়ায় সাগরতীরের কয়েক ফুট অংশ ভেঙে সাগরে মিশে গেছে। ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণে সেন্ট মার্টিনের কয়েকটি এলাকা ক্ষয়ের ঝুঁকিতে থাকলেও এ ধরনের ক্ষয়কে কেবল ‘মোখা’র প্রভাব বলতে নারাজ একজন বিশেষজ্ঞ। সাময়িকভাবে দ্বীপের স্থলভাগের কী পরিমাণ ক্ষয় হয়েছে বা সাগরে মিশে গেছে তা চিহ্নিত করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার এবং এনভায়রনমেন্টাল ওশানোগ্রাফি ও ক্লাইমেট বিভাগের প্রধান আবু শরীফ মো. মাহবুব–ই–কিবরিয়া জানান, দ্বীপের উত্তর পাড়া, মাঝের পাড়া ও গলাচিপা পাড়া ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে ঢেউয়ের তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে একটি পাড়ার জেটি এলাকার কিছু অংশ ভাঙতে ভাঙতে হোটেল স্থাপনার কাছাকাছি চলে এসেছে। সেন্ট মার্টিনের উত্তর দিকে উপকূলের কিছু অংশ ১০ থেকে ১৫ ফুট ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সাগরে মিশে গেছে। এছাড়া গলাচিপার কিছু অংশও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে পুরো দ্বীপের উপকূলে যেসব অংশে সেডিমেন্টেশন বেশি, সেগুলো অল্প করে হলেও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোখায় সেন্ট মার্টিনের অনেক গাছপালা ও বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, ঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাস বেশি না হওয়ায় খুব বেশি ভাঙেনি। তিনি জানান, দ্বীপের কতটুকু অংশ বিলীন হয়েছে তা নির্ধারণের পরিকল্পনা করেছে ইনস্টিটিউটের একটি দল। দ্বীপের ‘সয়েল প্রোফাইলিংয়ের’ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আবু শরীফ জানান, স্বল্প গভীরে (গড়ে ৩–৫ মিটারের মধ্যে) পাথর পাওয়া যাওয়ায় এ ‘রক আইল্যান্ডের’ সাগরে একেবারে বিলীন হওয়ার বা ডুবে যাওয়ার কোনো শঙ্কা নেই।
পরিবেশ অধিদপ্তর নিজেরাই বলেছে, ‘বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন সরকার ঘোষিত একটি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন এবং পর্যটকদের অসচেতনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, পরিবেশ ও প্রতিবেশবিরোধী আচরণের কারণে সেন্টমার্টিনের বিরল প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত।’
পরিবেশবিদদের অভিমত পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা মনে করেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিপুলসংখ্যক পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজন উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হবে দ্বীপটিতে পর্যটকদের আগমন একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা। এ সময়ের মধ্যে দ্বীপের সৈকত ও সৈকতসংলগ্ন সমুদ্রে পানির নিচে যত দূষণ হয়েছে সব পরিষ্কার করতে হবে। এরপর যখন নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে, শুধু তখনই নির্দিষ্ট মৌসুমে নির্দিষ্টসংখ্যক পর্যটককে শুধু দিনের বেলা এ দ্বীপে ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তাহলেই সেন্টমার্টিন দ্বীপে পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সেন্ট মার্টিন রক্ষায় আইন আছে, বিধিবিধান আছে, নির্দেশনা জারি করা আছে, প্রশাসন আছে, পরিবেশ অধিদপ্তর আছে, পুলিশ আছে, কিন্তু সবার সামনে দ্বীপটি ধ্বংস হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এখন থেকে আগামী পাঁচ বছরের জন্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের প্রবেশ যদি সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা যায়, তাহলে দ্বীপটির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। তাহলেই দ্বীপটি রক্ষা পাবে। না হলে যে অবস্থা চলছে, তাতে মানুষের চাপে দ্বীপটি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পর্যটক আগমন বন্ধ রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। দ্বীপে পর্যটক বা বহিরাগতরা যাতে না আসেন, সে জন্য দেশের মূল ভূখণ্ড ও দ্বীপের মধ্যে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে।