একটি ফুল। প্রস্ফুটিত হবার কথা ছিল। ফুটন্ত ফুলের সুবাস ছড়ানোর কথা ছিল। সুবাসিত হতে পারতো চারপাশ। কিন্তু প্রকৃতি সুবাসিত হতে পারেনি,নয়নজলে ভেসেছে। প্রস্ফুটিত হতে পারেনি সে ফুলটি। তার আগেই ঝরে পড়েছিল অবহেলায়।
ঝরে পড়া ফুলটির কথাই বলছি। প্রয়াত আতিক শাহরিয়ার মাহী। ২০০৩ সালের ৫ই অক্টোবর জন্ম গ্রহণকারী আঠারো/উনিশ বছরের দীর্ঘদেহী ফর্সা সুঠাম দেহের একটি ফুলের মতো ছেলে। লেখাপড়ায় মেধার পরিচয় দেবার পাশাপাশি সে চারুশিল্পী এবং আবৃত্তিকার হিসাবেও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছিল। মেয়রপিতা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও শিশু সংগঠক আইয়ুব বাবুল এবং সংস্কৃতিসেবী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মাতা বেগম চাঁদ সুলতানার স্নেহ–মমতার বন্ধনে বেড়ে উঠেছিল একমাত্র পুত্র মাহী এবং একমাত্র কন্যা নাহিদ সুলতানা এক বৃন্তে দুটি কুসুমের মতো। কেমন ছেলে ছিল মাহী? পটিয়া সদর থেকে তিন–চার মাইল দূরে অবস্থিত হাইদগাঁও গ্রামের এক ছেলে গাড়ির অভাবে স্কুলে আসতে পারছে না শুনে পরোপকারী মাহী নিজের সাইকেলটাই ছেলেটিকে দান করেছিলো। পরিবারটির সাথে পারিবারিক চিকিৎসক হিসাবে এবং সাংগঠনিক বিভিন্ন পর্যায়ে আমার আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে তিন যুগেরও বেশি সময়ব্যাপী।
তীব্র জ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত মাহীকে যথাসময়ে পটিয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখান থেকে চট্টগ্রাম শহরে নেয়া হয়। জরুরি চিকিৎসা দেয়ার পরে ঢাকায় রেফার করা হয়। ঢাকায় নেয়ার সময় পথিমধ্যে এমবুলেন্সে মাহী পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয়। দিনটি ছিল ২০২২ সালের ১৮ই জানুয়ারী। একমাত্র পুত্রহারা পিতামাতার আহাজারীতে গাছের পাতা ঝরেছে।
মাহির মৃত্যুর কারণ ছিল অপ্রতিরোধ্য করোনা সংক্রমণ। তাই যুক্তিসংগত কারণেই মাহী করোনা ভ্যাকসিন পেয়েছিল কিনা এ প্রশ্ন এসে যায়। অত্যন্ত দুঃখজনক হচ্ছে, মাহী করোনা ভ্যাকসিন পায়নি। মেয়র পিতা নিজে উদ্যোগী হয়ে পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিএইচএকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর ছেলেকে টিকা প্রদানের জন্য। মাহীর বয়স আঠারো বছর হতে আরও তিন মাস বাকী ছিল বিধায় টিএইচএ টিকা প্রদানে সম্মত হননি। তিন মাস পরে আঠার বছর পূর্ণ হবার পরে টিকা সাপ্লাই নেই এমনই অজুহাত দেখিয়ে মাহীকে পুনরায় টিকা থেকে বঞ্চিত করা হয়। একজন চিকিৎসক হিসাবে আমি নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ধরে বলছি আঠার বছর হবার আগে করোনা টিকা দেয়া যাবে না এ রকম নিয়মের কথা কোনও মেডিকেল সূত্রে নেই। বাংলাদেশে এ ধরনের নিয়ম ঐ সমস্ত আমলারা করেছে যাদের চিকিৎসা শাস্ত্রের ন্যূনতম জ্ঞান নেই। টিএইচএ যেহেতু একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক সেহেতু প্রশাসনিক গুরুত্বকে স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্বের উপর স্থান দেয়া তাঁর জন্য সমীচীন হয়নি। কারণ স্বাস্থ্যসেবার সাথে মানুষের জীবন মরণ জড়িয়ে আছে। তাই মেয়রপুত্রের টিকা বঞ্চিত হওয়ার দায় টিএইচএ এড়াতে পারবেন না। এবারে প্রশ্ন আসে মাহীর বয়স আঠার বছর পূর্ণ যখন হলো তখন তাকে টিকা দেয়া হয়নি টিকা সাপ্লাই নেই এমনি অজুহাতে। তখন প্রশ্ন এসে যায় তাহলে পৌর এলাকার টিকাগুলি যেগুলি সরকার হিসেব করেই দিয়েছিল সেগুলি কম পড়লো কেন? তাহলে কি পৌর এলাকার টিকা অন্য কোথাও দেয়া হয়েছে? কোনও ইউনিয়নে যদি টিকা বরাদ্দের চেয়ে অনেক বেশি দেয়া হয়ে থাকে তবে পৌর এলাকার টিকায় ঘাটতি হতে পারে। নির্ভরযোগ্যসূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, শোভনদণ্ডি ইউনিয়নে বরাদ্দের চেয়ে অনেক বেশি টিকা দেয়া হয়েছিল সরকার ঘোষিত টিকা প্রদানের দিনের সাতদিন আগে। সরকারি অনুমোদন ব্যতিরেকে মাইকিং করে লোক জমিয়ে টিকা প্রদান করা হয়েছিল বেআইনীভাবে টাকার বিনিময়ে টিএইচএ এর উপস্থিতিতে। কি এমন প্রয়োজন হয়েছিল সাতদিন আগে টিকা প্রদানের? বরাদ্দের বেশি সংখ্যক টিকা কেন দেয়া হয়েছিল? সরকারি ঘোষণা দেয়ার পরে মাইকিং কেন করতে হয়েছিল? বিনামূল্যে প্রদানযোগ্য সরকারি টিকা প্রদান করে টিকা গ্রহীতা থেকে কেন টাকা নেয়া হয়েছিল? টিএইচএ সেখানে কেন গিয়েছিলেন?এ সব কিছুর দায় নিতে হবে টিএইচকে। কারণ টিকা সংরক্ষণ, টিকা প্রদানের এবং প্রতিটি পটিয়া উপজেলাবাসীর টিকা প্রাপ্তির দায় দায়িত্ব তাঁর।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, উক্ত টিএইচএ এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কার্যক্রমের অর্থ আত্মসাৎ, গ্রাম পুলিশের ভাতার অর্থ আত্মসাৎ, কোল্ড চেইন না মেনে ইপিআই কোল্ড স্টোর থেকে ভ্যাকসিন বিতরণ করা সহ আরো অনেক দুর্নীতির অভিযোগ পত্রিকায় এসেছে। ‘আগেভাগে টিকাদান হুইপের শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে (প্রথম আলো, ০১–০৮–২১)। পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভ্যাকসিন কার্যক্রমের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ (সকালের সময়, ১৪–০৪–২২)।’ ‘গ্রাম পুলিশের ভাতার টাকা পটিয়া স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পেটে (আজকের সংবাদ, ১৪–০৪–২২)।’ ‘পটিয়ায় ইপিআই কোল্ড স্টোর থেকে ভ্যাকসিন বিতরণ (আজকের সংবাদ, ১০–০৪–২২)।’ ‘পটিয়ায় অর্থের বিনিময়ে করোনা টিকা প্রদান–চট্টগ্রামের পটিয়ায় শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে রেজিস্ট্রেশনবিহীন এবং বিধিবহির্ভূতভাবে অর্থের বিনিময়ে টিকা প্রদানের অভিযোগ উঠেছে ( বানগি নিউজ, ডট কম, ১০–০৪–২২)।’ ‘পটিয়ার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে চলছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে টিকা বাণিজ্য। পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জনৈক টেকনিশিয়ান দুই দিনে প্রায় চার হাজার মানুষকে অর্থের বিনিময়ে টিকা দিয়েছেন ( প্রবাসীর দিগন্ত ডট কম, ০১–০৮–২১)।’ ’পটিয়ার মেয়রপুত্রের মৃত্যু,স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিচার দাবী বিশিষ্টজনদের ( দৈনিক পূর্বদেশ ,২৮–১০–২৩)।’ ‘পটিয়ার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অপসারণের দাবীতে মানববন্ধন (দৈনিক আজাদী, ১৯–০১–২৩)।’ ‘ছেলের মুত্যুর জন্য স্বাস্থ্যকর্মকর্তাকে দায়ী করলেন পটিয়া পৌর মেয়র, বিচার চাইলেন আল্লাহর কাছে (দৈনিক পূর্বকোণ, ০৬–১০–২৩)।’ এমনি অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মেয়র আইয়ুব বাবুল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, মহাপরিচালকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু প্রায় পৌনে দুই বছর গত হলেও ঐ কমিটির প্রতিবেদন সম্পর্কে কোনও তথ্য জানা যায়নি এবং উক্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দাপ্তরিক কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সময়োচিত পদক্ষেপ কেন গ্রহণ করলেন না? কার ইন্ধনে? কার প্রতাপে? এ প্রশ্ন পটিয়াবাসী সকলের। শেষ খবর অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পুত্রহারা পৌর মেয়র মো. আইয়ুব বাবুল কর্তৃক প্রেরিত অভিযোগ লিপিবদ্ধকৃত চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর দফতর কর্তৃক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়কে উক্ত অভিযোগের সুরাহা করার নিমিত্তে সত্বও যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু সচিব মহোদয় কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পর্কিত কোনও তথ্য এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট।