প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানে সৌন্দর্যের মূলে রয়েছে পাহাড়ের রহস্যময় পর্যটন স্পটগুলো। ঝুঁকি নিয়েই জেলার থানচি, রোয়াংছড়ি, রুমা এবং সদর উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণে ভিড় জমাচ্ছে পর্যটকেরা। পাহাড়, আকাশ, নদী-খাল এবং ঝর্ণা ধারাগুলো এখানে মিলেমিশে একাকার। রহস্যময় পর্যটন স্পটগুলো ভ্রমণ সত্যিই দারুন রোমাঞ্চকর। রোয়াংছড়ি উপজেলার দেবতাখুম, শীলবান্ধা ঝর্ণা, থানচি উপজেলার রেমাক্রী বড়পাথর, নাফাখুম, অমিয়খুম ঝর্ণা, সাতভাইখুম, রুমা উপজেলার জাদীপাই ঝর্ণা, রোমানাপাড়া ঝর্ণা, চিংড়ি ঝর্ণাসহ দর্শনীয় স্পটগুলো যতটা না দৃষ্টিনন্দন তারচেয়েও বেশি বিপজ্জনক। তবু ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের কাছে দৃষ্টিনন্দন রহস্যময় পাহাড়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন স্থানগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেড়াতে আসা পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও এখন ভিড় জমাচ্ছে পর্যটন স্পটগুলোতে।
প্রশাসন ও স্থানীয়রা জানান, রহস্যময় দেবতাখুম যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে রোয়াংছড়ি উপজেলায়। বান্দরবান জেলা শহর থেকে রোয়াংছড়ি উপজেলার দূরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার। সেখানে রোয়াংছড়ি থানা থেকে পুলিশের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের কচ্ছপতলী আর্মি ক্যাম্পে। সেখান থেকে পুনরায় অনুমতি নিয়ে প্রশাসনের তালিকাভুক্ত গাইডদের সহযোগিতায় পৌঁছাতে হবে দেবতাখুম। তবে ভ্রমণের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের দুইটি ফটোকপি অনুমতির জন্য জমা দিতে হয়। রোয়াংছড়ি থেকে কচ্ছপতলী ৫-৬ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ। কাগজপত্র জমা দিয়ে অনুমতি নেয়ার পর দেবতাখুমের উদ্দেশে ট্রেকিং। এটি মোটামুটি মাঝারি মানের একটি ট্রেকিং রুট বলা চলে। কচ্ছপতলী থেকে দেবতাখুম পৌঁছতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টার মতো। পাহাড়, বন ও কয়েকটি ঝিরির পাশ দিয়ে ট্রেকিং করার মুহূর্তগুলো দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর। কখনো চড়াই বেয়ে উপরে উঠা, আবার কখনও নীচের দিকে বেয়ে নামতে নামতে পৌঁছে যাওয়া শীলবান্ধা পাড়ায়। এখান থেকে যাওয়ার সময় পথে সুন্দর মনমাতানো ভ্যালিও চোখে পড়ে। শীলবান্ধা পাড়ার পাশে শীলবান্ধা ঝর্ণা নামে একটি ঝর্ণাও আছে। যদিও আকারে খুব ছোট এবং শীতকালে পানি খুবই কম থাকে।
স্থানীয় ট্যুরিস্ট গাইড মো. রাহাত ও বাপ্পা দাস বলেন, শীলবান্ধা থেকে দেবতাখুমের ভিতরে ঘুরে দেখার জন্য নৌকা ও বাঁশের তৈরি ভেলার ব্যবস্থা রয়েছে। জনপ্রতি ১৫০ টাকায় লাইফ জ্যাকেটসহ এ সুবিধা পাওয়া যায়। প্রতিটি ভেলায় একজন এবং নৌকায় সর্বোচ্চ ১০ জন উঠা যায়। খুমের ভিতরে গভীরতা ৫০ থেকে ৭০ ফিট এবং দৈর্ঘ্যে ৬০০ ফিটের মত। এটি বর্তমানে বান্দরবানের অন্যতম জনপ্রিয় ভ্রমণ স্থানে পরিনত হয়েছে।
বেড়াতে আসা পর্যটক মিরাজ আহমেদ, অনন্যা রহমান ও ফারজানা রুহী বলেন, দেবতাখুম পর্যটন স্পটটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। পাহাড়ে ট্রেকিং সবার জন্য সবসময়ই রোমাঞ্চকর। আর সেটি যদি হয় পাহাড়ি ঝিরিপথে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, তাহলে আনন্দটি বেড়ে যায় বহুগুনে। দেবতাখুম ভ্রমনের পর যাবার সব দু:খ-কষ্ট, বেদনা কিংবা ক্লান্তি মুগ্ধতায় হারিয়ে যায়।
রোয়াংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌহিদ কবীর বলেন, দেবতাখুম এবং শীলবান্ধা ঝর্ণা স্পটগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটকেরা ভিড় জমাচ্ছে। স্থানীয় দর্শণার্থীদের সংখ্যাও কম নয়। তবে শুক্র-শনিবার পর্যটকের চাপটা থাকে সবচেয়ে বেশি। নিরাপত্তার স্বার্থে থানা, আর্মি ক্যাম্পে নাম-ঠিকানা জমা দিয়ে প্রশাসনের তালিকাভুক্ত একজন স্থানীয় গাইড সঙ্গে নিয়েই দেবতাখুম ভ্রমণে যেতে হয়।
অপরদিকে জেলা সদর থেকে থানচি উপজেলার দূরত্ব ৮৫ কিলোমিটার। পাহাড়ের গা ঘেঁষে উঁচুনিচু রাস্তায় ছুটে চলে গাড়িগুলো। থানচি পৌঁছানোর পর ইঞ্জিন চালিত বোটে করে যেতে হবে রেমাক্রী ইউনিয়নে। মধ্যেখানে নদীর চড় বেয়ে পাঁয়ে হাটার পথও রয়েছে। সবমিলিয়ে রেমাক্রী পৌঁছাতে সময় লাগবে তিন থেকে চার ঘন্টা। রেমাক্রীতে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে প্রবাহিত সাঙ্গু নদীর স্বচ্ছ পানির দৃশ্য মুগ্ধ করে পর্যটকদের। রেমাক্রীতে সাঙ্গু নদীকে মনে হয় পাথরের নদী এবং বয়ে চলেছে স্বচ্ছ পানির ঝর্ণা ধারা। সত্যিই অন্যরকম এক সৌন্দর্য্য। তবে রেমাক্রীতে পাথরের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে বিপদের শঙ্কাও। রাত্রিযাপনে রয়েছে পার্বত্য জেলা পরিষদের দুটি কটেজ। এছাড়াও স্থানীয় পাহাড়িদের মাচাং ঘরেও অর্থের বিনিময়ে রাত্রি যাপনের বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। রেমাক্রীমুখ থেকে নাফাকুম ঝর্ণা ভ্রমণ যতটা রোমাঞ্চকর, তার চেয়ে বহুগুনে বিপজ্জনক। পাহাড়ের ঢালে ঢালে প্রায় তিন ঘন্টা পাঁয়ে হাটার রাস্তা। দূরত্ব প্রায় এগারো-বারো কিলোমিটার। নেই নাফাকুম যাবার কোনো রাস্তাও। ভ্রমন পিপাসুরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বন-জঙ্গল মারিয়ে নাফাকুমে যাচ্ছেন। যাবার পথে ছোটছোট কয়েকটি খাল-ছড়াও পার হতে হয়। তবে চলাচলের রাস্তা এবং থাকার কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও ভ্রমনে নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যটকদের সঙ্গে একজন স্থানীয় গাইড নেয়ার নিয়ম রয়েছে প্রশাসনের। নাফাকুম ঝর্ণার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে ভ্রমনের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে নিমিষেই। তবে অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, দর্শণীয় স্থানটিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে নাফাকুমে নানা রকমের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে ভ্রমন পিপাসুরা। নাফাকুমে বিশেষ বিশেষ জায়গায় প্রশাসনের নেই কোনো সতর্ক চিহ্ন। পর্যটকেরা সতর্ক চিহ্ন না থাকায় এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে পড়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। নাফাকুম ঝর্ণায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়া প্রশাসন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নাফাকুম ঝর্ণার সৌন্দর্য বর্ধনে কোনো উন্নয়ন কর্মকান্ড করা হয়নি। ঝর্ণার খরস্রোতে পা পিছলে পড়ে গেলে কোথাও আটকা পড়ে প্রাণ বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। সম্পূর্ন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ভ্রমন পিপাসুরা নাফাকুমের সৌন্দর্য উপভোগ করতে যান।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, দেশের পর্যটন সম্ভাবনাময় জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম বান্দরবান। এখানে পাহাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য দর্শণীয় স্থান। পর্যটন শিল্পের প্রসারে নানামুখী উন্নয়ন কাজ সম্পাদন করা হচ্ছে। নতুন নতুন পর্যটন স্পট খুঁজে বের করা হচ্ছে। পর্যটকদের নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমন নিশ্চিত করতে কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসন।