গোলাম মোহাম্মদ–একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস। সমাজবোধসম্পন্ন মানুষের বাতিঘর, আঁধার জগতের পেঁজাতুলো ভেদ করে ফর্সা আকাশের আলোচ্ছটা যেন একজন গোলাম মোহাম্মদের জীবন্ত শরীর। টগবগে তরুণ যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়–নবীন কারিগরের মতন ধোঁয়াশা তুলে পিচ্ছিল পথে কর্দমাক্ত শরীর মাড়ায়–তিনি তাদের মতন এক স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব। হ্যাঁ বলছিলাম সেই একটি নাম, একটি নতুন প্রজন্ম, একটি পুরাতন প্রজন্ম–সবকিছুর সংমিশ্রণে গাঁথা সকালের আলো ছড়ানো সেই দ্যুতিময় মানুষটির নাম একজন গোলাম মোহাম্মদ। যার পদচারণায় মুখরিত ছিল হৃদ্ধ সামাজিক প্রতিষ্ঠান রাউজান ক্লাব অঙ্গনের সবুজ পাঠশালা–যেখানে অহর্নিশ আগমনে ভরাট ছিল নিঃস্ব মানুষদের। আহাজারিতে সয়লাব হত মর্মর পাতার পদধনি। দু’চোখের কোণায় যেন মারিয়ানা ট্রেন্সের আবির্ভাব। হ্যাঁ এই তো সেদিন খুব কাছাকাছি ছিল এই সৌরভ সৌষ্ঠবে ভরা যৌবন। হিংস্র শকুনের থাবায় মুখরিত অঙ্গন আজ চরমভাবে বিধ্বস্ত। অমানিশার কালো মেঘে ছেয়ে গেছে ক্লাবের সমস্ত আবহ। কিন্তু সটকে পড়েনি কেউ। দ্বিগুণ মাত্রায় উদ্যম ভরা সাহস নিয়ে এগিয়ে যায় কন্টকাকীর্ণ পথ জয় করে। দীর্ঘকালীন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন এই জ্যোতির্ময় মানুষটি। সুবহে সাদিকের ফর্সা আলো ভেদ করে যখন নীরবতা ভাঙে শেষ জমিনের প্রান্ত আর তখনই নির্ঝর শরীর নিয়ে এগিয়ে যায় সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থান মসজিদের দিকে। আল্লাহর রাহে জীবন গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ছুটে চলা এই অদম্য মানুষটি কঠোর পরিশ্রমী ও তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন ছিলেন। তিনি রাউজানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চষে বেড়াতেন। সামাজিক দায়বদ্ধতাসম্পন্ন গোলাম মোহাম্মদ ভাইয়ের জীবনটাই ছিল সংগ্রামমুখর। সমাজের প্রতিটি মানুষের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। আল্লাহ তায়ালার একজন খাঁটি বান্দা হিসাবে আল্লাহর ফরজ বিধানগুলো মেনে চলার চেষ্টা করতেন। রাউজানের চেম্বারে থাকাকালীন উনার সরব যাতায়াত ছিল। একদিকে আত্নীয় অন্যদিকে ক্লাব সম্পাদক–দু’টির সম্মিলনে আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর ও মধুর। অনেক ঘাত–প্রতিঘাতের জীবন্ত সাক্ষী ছিলেন তিনি। রাউজান ক্লাবের সমস্ত কার্যক্রম ঘিরে উনার স্বপ্ন ছিল আকাশচুম্বি। ক্লাবের অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে উনার মেহনত ছিল অতুলনীয়। প্রতি শুক্রবার ক্লাব পরিচালিত হাফেজ বাদশা মিয়া দাতব্য চিকিৎসালয়ের সমস্ত কর্মযজ্ঞ উনি একাই পালন করতেন। রোগী এন্ট্রি করা, নামমাত্র মূল্যের রিসিট দেওয়া, রোগীর সিরিয়াল নেওয়া সবকিছুই উনি একাই সামাল দিতেন। ক্লাবের অন্যান্য কর্মীরা আসার আগেই উনি অগ্রিম কাজগুলো সেরে ফেলতেন। কোন ধরনের গাফিলতি ছিল না তাঁর মাঝে। সব কিছুই হাসিমুখে বরণ করে নিতেন। হতদরিদ্র মানুষগুলোকে খুব কাছের মানুষ হিসাবে নিয়েছিলেন তিনি। তাদের দুঃখ দুর্দশা বুঝতেন, উপলব্ধি করতেন। রাউজান ক্লাব পরিচালিত রাউজান ক্লাব যাকাত তহবিল থেকে বিভিন্ন অনুদান সংগ্রহ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে বিলি করতেন এবং উনার রেফারেন্স অনুযায়ী অনেক দরিদ্র মহিলাদের সেলাই মেশিন প্রদান করতঃ তাদেরকে স্বাবলম্বি করার চেষ্টা করতেন। এমনকি দুগ্ধজাত গাভী প্রদান করে অনেক অসহায় মহিলাদের সংসারে সুখ শান্তি এনে দিয়েছেন এই মহান মানুষটি। সবকিছু সম্ভব হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালা অশেষ রহমত এবং এই অদম্য মানুষটির অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। উনি একাউন্টস ভাল বুঝতেন এবং অডিট বিষয়ে পারদর্শী। ইথিক্যাল ড্রাগস কোম্পানী লিমিটেড এর একজন বিপণন প্রতিনিধি হিসাবে যোগদান করার আগে একটি বেসরকারি কোম্পানীর হিসাব বিভাগে চাকরি করতেন। তাই, হিসাব বিষয়ে উনার দখল ছিল অনেক উন্নত। উনি সাবলীলভাবেই ক্লাবের সমস্ত হিসাব–নিকাশ একাই করতেন এবং তা প্রতি বৎসর উপজেলা সমাজসেবা অফিসে দাখিল করতেন। সমাজসেবা অফিস থেকে কোন অডিট আসলে উনি একাই সামলাতেন। ক্লাব কর্মযজ্ঞ যেন নির্বিঘ্নে হয় সেজন্য তিনি অনেক সময় খুব সকালে এসে ক্লাব অফিসে নিবিষ্টচিত্তে কাজ করতেন। ক্লাব পরিচালিত রাউজান ক্লাব ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রাউজান ক্লাব কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এগুলো একজন যোগ্য সম্পাদক হিসাবে দেখভাল করতেন এবং সংশ্লিষ্ট প্রকল্পসমূহের কর্মকর্তাদের সাথে বিভিন্ন সংকট নিরসনে মতবিনময় করতেন এবং একটি উপায়যোগ্য সমাধান দিতেন। দীর্ঘ ১৫ বছরের সম্পৃক্ততায় ক্লাবের কর্মকান্ডের বিস্তৃতি অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন সফলতায় ভরা কর্মমুখর মানুষটি। হঠাৎ যেন মরুভুমির এক ধুলোঝড় এসে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করে দিয়েছে। হিংস্র শকুনের চোখ পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির উপর। সবকিছু এলোমেলো–অবিন্যস্ত সমাজকর্ম। অভিমানের প্রলয়সঙ্গী যেন দু’জনার মাঝে। এ যেন এক মধুর সম্পর্কের পোস্টমর্টেম। বিকৃত মানুষগুলো সমাজকর্মকে ব্যাহত করার চেষ্টা চালিয়েছে বহুবার। মহান আল্লাহতায়ালার একান্ত অনুগ্রহে আজও টিকে আছে সৎ, নির্ভীক, যোগ্য ও দক্ষতাসম্পন্ন মানুষগুলোর সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানটি। বন্ধ দরজার ভেতর দুর্দান্ত সাহস বেড়ে উঠে–ভেতরে আন্দোলিত হয় অনন্ত যৌবন–উৎসাহিত হয় আগামী প্রজন্ম। থেমে নেই কর্মযজ্ঞ– সুনসান নিরবতা ভেঙ্গে জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে মরুভুমির বালুচরে। এই তো সেদিন এই কর্মবীর মানুষটিকে আমরা হারিয়েছি। যেন বা বেদনার তপ্ত রোদে আমরা পুড়ছি আর পুড়ছি। দহনের বহ্নিশিখায় উদ্বেলিত হয় অপ্রতিরোধ্য অঙ্গারে। তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতি আমাদেরকে আগামীর পথচলায় সাহস জোগাবে। সত্যের পথে বাধা আসবেই। কল্যাণের পথে অনেক ঝড়ঝাপটা আসবেই। সবকিছুর নিঃশেষ হবে একদিন। সাঙ্গ হবে লীলাখেলা। আমরা অপ্রতিরোধ্য, দুর্জয়, অহংকারের প্রাসাদ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেব–বের করে নিয়ে আসবো সুসংগঠিত পাঠশালা। আবারও জ্বলে উঠবে গহিন আঁধার। আঁধারের বিন্ধ্যাচল পেরিয়ে এগিয়ে যাবে যুথবদ্ধ শরীর। কোন এক সন্ধ্যে বেলায় প্রসিদ্ধ জান মোহাম্মদ ফকির বাড়ীর মাটির ঘরে শুইয়ে দিয়ে এসেছিলাম ভাইটিকে। আর কোনদিন আসবে না এই নীড়ে–যেমনটি পাখিরা আবারও নীড়ে ফিরে আসে। তিনি চলে গেছেন দূর সীমানায়। যেখান থেকে ফেরে না কেউ। আখেরাত তো শুরু হয়ে গেছে তাঁর এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। চিন্তা করবেন না আমার ভাইটি। আমরাও খুব সহসাই সহযাত্রী হব আপনার সাথে। আপনার রেখে যাওয়া নেক সন্তান ও ছদকায়ে যারিয়া আপনার জন্য যেন নাজাতের উছিলা হয়। আপনার কবরকে আল্লাহতায়ালা যেন জান্নাতের সুগন্ধিযুক্ত বাতাসে সয়লাব করে দেয়। জীবনের প্রতিটি কর্ম যেন প্রেরণাদায়ক হয়। আমরা যেন সেই প্রেরণার কর্মী হয়ে এগিয়ে যেতে পারি দুর্ভেদ্য প্রতিরোধক ভেঙ্গে। একজন গোলাম মোহাম্মদ আর কোনদিন আসবে না। কিন্তু তাঁর সাবলীল কর্মগুলো রয়ে যাবে তরুণ প্রজন্মের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে। ক্লাব কর্মকান্ডগুলোকে সুবিন্যস্তভাবে গোছানোর কাজে যে কঠোর সাধনা তিনি করে গেছেন তাঁর কথা ক্লাব কর্মীরা আজীবন মনে রাখবে। তাঁর সমস্ত দোষত্রুটি মহান আল্লাহতায়ালা যেন ক্ষমা করে দেন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সু–উচ্চ মাকাম দান করেন–সেই দোয়াটুকুই করছি। তাঁর সন্তান–সন্ততিদের আল্লাহতায়ালা খোদাভীরু হিসাবে গড়ার তৌফিক দেন। এই দিন দিন নয় আরও দিন আসবে–যেদিন দলে দলে এই কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠানের সহযোদ্ধা হবে অসংখ্য তরুণ। মিছিলে মিছিলে জয়গান–তুমুল উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা এই প্রজন্ম। সমস্ত বিষাদ পেরিয়ে এই অঙ্গন আবার মুখরিত হবে– সবুজে সবুজে মাতোয়ারা হবে ক্লাবের পবিত্র অঙ্গন। আবারও আমরা মিলিত হব অচিরেই সমস্ত বাধা ভেঙ্গে। পালাতে শুরু করবে হিংস্র শকুনেরা। সত্যের জয় সু–নিশ্চিত, মিথ্যা অপসারিত, ‘তুমি বল, সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে; অবশ্যই মিথ্যাকে বিলুপ্ত হতে হবে’– সূরা বনি ইসরাঈল– ৮১।
লেখক : সভাপতি–রাউজান ক্লাব
সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল