অতি সম্প্রতি হাটহাজারির কাটিরহাটে পাহাড় সংলগ্ন এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছিলাম শীতবস্ত্র বিতরণের কাজে। এ কাজের নেতৃত্বে ছিল বিবেকানন্দ শিক্ষক সংস্কৃতি পরিষদ, চট্টগ্রাম। এ সেবামূলক কাজের জন্য সংগঠনের প্রাক্তনী ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে অর্থ জোগাড় করা, শীতবস্ত্র কেনা, স্থান নির্বাচন, কাঁধে করে শীতবস্ত্র ঐ জায়গায় পৌঁছানো, এবং বিতরণসহ সবকাজ নিরলসভাবে করে গেল একদল যুবক যারা ঐ সংগঠনের সদস্য। সংগঠনের মূলভাব ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’। মূলতঃ স্বামী বিবেকানন্দের ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ এর সংক্ষিপ্তভাব। ঐদিন উক্ত জায়গায় শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণকালে একজন সদস্য লক্ষ্য করলেন, ছোট ছোট অনেক শিশু; যাদের গায়ে শীতের কাপড় নেই। প্রচণ্ড শীতে এমনও একজন চলে এসেছে একেবারে খালি গায়ে। জিজ্ঞেস করায় জানালো, একটিই জামা সেটি ধুয়ে দিয়েছে। কী অবর্ণনীয়! এসময়ে এসে ছোট্ট একজন শিশুর একটি মাত্র কাপড়? সদস্যটি উপস্থিত কয়েকজনের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল এসব ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য কিছু করতে হবে। তারই ফলস্বরূপ আবারও প্রতিউদ্যোগ নেওয়া হলো। ওখানকার দুটো গ্রামে প্রায় শত দেবশিশুকে শীতের কাপড় ও শিক্ষা উপকরণ উপহার দেয়া হয়। পরবর্তীতে উক্ত সদস্যের সাথে আমার এ প্রতিউদ্যোগ নিয়ে কথা হয়। জানালো পুনরায় এই দেবশিশুদের জন্য কিছু করার তাগিদ এসেছে স্বামীজির অনুপ্রেরণা ও সাহসে। আর কীভাবে পারলে পুনরায়? জানালো, সৎ কাজে সবাই উৎসাহ দেয় ও সহযোগিতা করে। এই যে যুবক ভাইটি অনুপ্রেরণার কথা জানালো এটি সব মানুষের মধ্যে সব সময় আসে না। এ ধরনের আত্মবিশ্বাস আসতে হলে আপনাকে যুক্ত থাকতে হবে সেবামূলক কোনো সংগঠনের সাথে; চর্চা করতে হবে কোনো একটি সৎ আদর্শ। বিবেকানন্দ শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিষদ সে রকম একটি সংগঠন। যেখানে কেউ সহজে নেতা হতে চায় না, বরং সেবার মানসিকতায় বিশ্বাসী। যুবক ভাইটিকে অনুপ্রেরণাদায়ী স্বামী বিবেকানন্দের আজ জন্মদিন। জন্মদিনে আমি এ মহান ঋষিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
একজন যুবকের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগানোটা বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ। আজকাল যুবকরা বিশ্বাসই করতে চায় না, তাদেরকে দিয়ে বড় বড় কাজ সম্ভব। এক ধরনের ভয় তাদের মধ্যে কাজ করে। স্বামীজি বলেন, আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেলেই সব বাঁধা দূর হবে, বড় বড় কাজ সাধন হবে। যে নিজের শক্তির ওপর বিশ্বাস করে না, তার কখনো ঈশ্বরের শক্তির প্রতি বিশ্বাস আসবে না। ঈশ্বরকে জানতে হলে, আগে নিজেকে জানতে হবে। নিজেকে জানলেই, নিজের প্রতি বিশ্বাস আসলেই, আমরা প্রত্যেকেই বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবো– এটাই মূলত স্বামী বিবেকানন্দের যুবসমাজের প্রতি মূল আহ্বান। তিনি যুব সমাজকে আরও আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাঁর নিজের ভিতর যে অন্তর্নিহিত দেবত্ব সেটাকে জাগিয়ে মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার জন্য। তিনি শিখিয়েছেন যখনই তুমি পরের জন্য ভাববে, তুমি বেঁচে থাকবে। আর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যখনই নিজের জন্য ভাববে, তখন তুমি মৃত। পরের জন্য ভাবলে জগৎ তোমার। এই জগতে নেতৃত্ব দিতে হলে তোমাকে ঝুঁকি নিতে হবে। আর নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তুমি যদি হেরে যাও তাহলে অপরকে পথ দেখাবে। তোমার দেখানো পথে আরেকজন নেতৃত্ব দিয়ে জগতকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে। কথাগুলো কি অনুপ্রেরণাদায়ী চিন্তা করছেন? আমি মনে করি এই কথাগুলো যদি একজন যুবক মেনে চলে, তবে সে যেকোন সংগঠনের সদস্য হয়ে যথাযথ সেবামূলক কাজ করতে পারবে এবং আদর্শ মানুষ হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। বৃহৎ চিন্তা ও কাজ করার শক্তি ও সাহস পাবে।
স্বামী বিবেকানন্দের এ কথাগুলো থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে যে মানুষটি বৃহৎ চিন্তা ও কাজ করেছিলেন তাদের একজন অগ্নিযুগের বিপ্লবী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাস্টারদা সূর্যসেন। আজ আবার মাস্টারদা সূর্যসেন এর মহাপ্রয়াণ দিবস। গভীর শ্রদ্ধা এ সাহসী দেশপ্রেমী নেতার প্রতি। মাস্টারদার সহপাঠী চট্টগ্রামেরই আরেক বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর কাছে শুনেছি, নেতাজি সুভাষ বসু সহ সকল বিপ্লবীরা যার আদর্শে উজ্জীবিত তিনি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। দেশপ্রেম নিয়ে লেখা স্বামী বিবেকানন্দের বিভিন্ন বই থাকতো বিপ্লবীদের ব্যাগে। এ প্রসঙ্গে শংকরী প্রসাদ বসু‘র ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’–এর ষষ্ঠ খণ্ডে ‘বিবেকানন্দ ও বিপ্লব আন্দোলন’ অধ্যায়ে বিপ্লবী অনন্ত সিংহের লেখা ‘সূর্য সেনের স্বপ্ন ও সাধনা’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখছেন– “সূর্য সেন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে কতখানি প্রভাবিত ছিলেন, সে সম্বন্ধে কিছু তথ্য দিয়েছেন তাঁর আর এক সহকর্মী অনন্ত সিংহ। ‘মাস্টারদা বিনয়ের সঙ্গে অথচ অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে চারজন বিপ্লবী বন্ধুকে বললেন, ‘আমরা চট্টলার বুকে বসে মাত্র এই পাঁচজনে ব্রিটিশদের লাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবের পরিকল্পনা করছি। আমার মনে হয় বর্তমানে মূলত আনন্দমঠের আদর্শে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের চলা উচিত এবং স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগের বাণী পাঠ আমাদের কর্তব্য হওয়া প্রয়োজন। সবাই আলোচনার পরে মাস্টারদার এই সমস্ত প্রস্তাবগুলো মেনে নিলেন। পরে বিপ্লবীরা সবাই স্বামীজীর বিভিন্ন বই ঘরে রাখত এবং নিয়মিত পড়ার পরে নিজেরে মধ্যে পাঠচক্রে মিলিত হত।”
মূলতঃ ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার নিজ চোখে দেখে, স্বামী বিবেকানন্দ দেশের মুক্তির চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। একজন সন্ন্যাসী হিসেবে মোক্ষ লাভ করায় স্বামীজীর মূল লক্ষ্য ছিল। কিন্তু তিনি তা করলেন না– দরিদ্র নিপীড়িত দেশবাসীর মুক্তিই ছিল তার একমাত্র কাম্য। এতটাই দেশপ্রেমিক ছিলেন যে, দেশমাতৃকাই ছিল তার একমাত্র আরাধ্য দেবী। তিনি এও জানতেন যে, শত বছরের এই অত্যাচার, অনাচার থেকে একমাত্র যুবকরাই দেশকে উদ্ধার করতে পারবে। এজন্যই তিনি যুব সমাজের ওপর আলাদা গুরুত্ব দিয়ে তাদেরকে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে এক চিঠিতে তিনি লিখেন, “আমি এই যুবক দলকে সঙ্ঘবদ্ধ করিতেই জন্মগ্রহণ করিয়াছি। সারা ভারত জুড়ে শত শত যুবক আমার সাথে যোগ দেবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে। এই যুবকরা যাহারা সর্বাপেক্ষা দীন হীন ও পদদলিত– তাহাদের দ্বারে দ্বারে সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য, নীতি, ধর্ম ও শিক্ষা বহন করিয়া লইয়া যাইবে –ইহায় আমার আকাঙক্ষা ও ব্রত, ইহা আমি সাধন করিব কিংবা মৃত্যুকে বরণ করিব।’ এ থেকেই বুঝা যায় স্বাধীনতার জন্য তৎকালীন ভারতবর্ষে যুব সমাজকে সংগঠিত করার জন্য প্রথম, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সফল যুবনেতা। তিনি শুধু যুবকদেরকে সংগঠিতই করেননি, অনুপ্রেরণার মাধ্যমে তাদের অন্তরে নিজ আদর্শ সঞ্চারিত করেছিলেন। পাশাপাশি কার্যকরী পরিকল্পনা দিয়ে তাদের কাজেও নামিয়েছিলেন।
স্বামীজির জীবনকাল ছিল মাত্র ৩৯ বছর। কিন্তু মূল কার্যকাল ছিল ১০ বছর। এই সামান্য সময়ে বিশ্বে এমন এক আলোড়ন তিনি সৃষ্টি করেছিলেন যার জন্য পাশ্চাত্য দুনিয়া থাকে ‘সাইক্লোনিক মঙ্ক’ অভিধায় ভূষিত করেছিল। তাঁর কর্ম ও প্রেরণায় আজও অনেকে আত্মবিশ্বাস অর্জন করে যাচ্ছে এবং জীবনযুদ্ধে জয়ী হচ্ছে।
লেখক
প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়