মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা। এই যুদ্ধে বিজয়ের মধ্যে দিয়েই আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন দেশ, নিজস্ব পতাকা। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে সাড়াদিয়ে বাংলার ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনগণ বর্বর হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তারই পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে খোদিত হয় একটা নাম- ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ’।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের অনুগত এদেশীয় দালালরা যে মানবতাবিরোধী কার্যক্রম করে এবং নির্মম ভাবে তারা ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা, ৪ লক্ষ নারীকে ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি কুকর্ম করে। এই কুকর্মকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করে জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল। রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামে বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে তারা ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। সে সময় সাধারণ মানুষের ধনসম্পদ লুট করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এই অপশক্তি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও গলার কাঁটার মতো যে ক্ষোভটি আটকে আছে, তা হলো- এদেশে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডে যুক্ত আছে। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধিতা করে যেসব রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহত্যা, নারী নির্যাতন আর নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছিল বাংলার মুক্তিকামী জনতার ওপরে, তারাই এখন স্বাধীন দেশে রাজনীতি করছে এবং নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে এরাই কলঙ্কিত করেছিল বিভিন্ন সময়ের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে কুখ্যাত রাজাকার, আল-বদর কমান্ডার এদেশে মন্ত্রী হয়েছিল; সাঈদী, শাহ আজিজ, সাকা চৌধুরীর মতো যুদ্ধাপরাধীরা এদেশের পবিত্র সংসদকে কলঙ্কিত করেছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের একেবারে শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের সদস্যরা। বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করলেও পঁচাত্তরের পর এ বিচার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ দিনের সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি আনে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিচার কাজও শুরু করে তারা। রাজাকার কাদের মোল্লার লঘুদণ্ডের প্রতিবাদে ২০১৩ সালে সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন আন্দোলন শুরু করে। কেবল সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শান্তির রায়ই নয়; যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামাত ও তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিও উত্থাপিত হয় তখন সারা দেশের আন্দোলন থেকে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে আশাব্যঞ্জক কার্যকর অগ্রগতি ও কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় ইতিমধ্যে কার্যকর এবং বাকিদের বিচারকার্য চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো সত্য আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে। এই বিচারকার্য পরিচালনার সময়েই আমরা দেখছি, যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন ও তাদের পরিবারের সদস্যরা কিভাবে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত করেছে এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। আমরা দেখেছি, যুদ্ধাপরাধীদের দোসররা রাজনৈতিকভাবে এখনও সক্রিয় রয়েছে, এদেশকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ও অর্থায়নে যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ত থাকার ঘটনাও নানা সময়ে তথ্য-প্রমাণ সমেত গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সমপ্রতি দেশে একাত্তরের পরাজিত অপশক্তির নব-উত্থান লক্ষ্য করছি আমরা। যদিও আদালতের আদেশে রাজাকার সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন, তবুও তাদের কেউ ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে, কেউ বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। অর্থাৎ বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন ও পরিবারের সদস্যদের অংশ নেওয়াটা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য এটি লজ্জাজনক বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর স্পষ্ট বক্তব্য এখন সময়ের দাবি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার ও বাহাত্তরের সংবিধানের মূলভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে হবে। একাত্তরের ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আমাদের নতুনভাবে ভাবতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধানে তাদের রাজনীতি করার কোনও অধিকার ছিল না ঠিকই কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর কেবল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় বিষয়টি আর আটকে নেই। ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা বাংলাদেশবিরোধী নানাবিধ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে, অর্থায়ন করছে জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদকে। সুতরাং তাদের নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে এখনই সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যুদ্ধাপরাধীদের উত্তরাধিকারদের মদদে সংঘটিত জঙ্গিসন্ত্রাস। জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ না হবার কারণে বা জামাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত সদস্যদের রাজনৈতিক অধিকার রহিত না হবার কারণে কার্যত বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন ঘটছে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেও সরকার এখনই বিষয়টি বাস্তবায়ন করবেন বলেই আমাদের প্রত্যাশা। জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রশ্ন এলেই একদল সুবিধাবাদী শাক দিয়ে মাছ ঢাকার নানা গল্প ফাঁদেন। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের ইতিহাস পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের রাজনৈতিক অধিকার রহিত করা হয়েছে। কেবল সংগঠনের সদস্যরাই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারও রহিত করা হয়েছে। জার্মানিতে নাৎসি নির্মূলকরণের অভিজ্ঞতা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। জার্মানরা নানা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে নাৎসিদের মানবতাবিরোধী দর্শন মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। পার্টি নিষিদ্ধ ও সহ-সংগঠনগুলো অবলুপ্ত করার পাশাপাশি তাদের যাবতীয় সম্পদও বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই উদাহরণের পাশাপাশি জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধের আইনি নির্দেশনাও স্পষ্ট। একাধিক যুদ্ধাপরাধীর রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হয়েছে এবং নিষিদ্ধের আর্জিও আছে রাষ্ট্রপক্ষের তরফ থেকে। সুতরাং এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে যদি বর্তমান সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হবে নি:সন্দেহে ভালো কাজ।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে দ্রুত নতুন আইন করতে হবে সরকারকে। তবে এ-সংক্রান্ত আইন পাসের আগেই বহু দণ্ডিত ও অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী তাদের সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করে দিয়েছে বলে জানা গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইনে দণ্ডিত বা অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি ক্রোক ও বাজেয়াপ্ত করার বিধান নেই। তবে কারান্তরীণ বা পলাতক যুদ্ধাপরাধীরা যাতে সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে না পারে, সে উদ্যোগ নিয়েছে আইসিটির তদন্ত সংস্থা।
রাজাকার শিরোমণি জামায়াত আমির প্রয়াত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, ‘সাধারণ জ্ঞান ও দালিলিক প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, জামায়াত ও এর অধীন সংগঠনের প্রায় সবাই সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় একাত্তরে গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী একটি অপরাধী দল হিসেবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে’। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধুর খুনি ও দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার একটি প্রস্তাব জাতীয় সংসদে তোলা হলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এর পর প্রায় সাত বছর হয়ে গেলেও এ নিয়ে কোনো আইন হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে অবশ্যই আইন করা দরকার। এ জন্য আইসিটি আইনটিও সংশোধন করতে হবে।
চট্টগ্রামের কুখ্যাত রাজাকার শিরমনি সাকা চৌধুরীর বিচার শুরুর আগেই বাড্ডা এলাকায় থাকা তার প্রচুর সম্পত্তি পানির দামে বিক্রি করা হয়। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের আগেই তার সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়েছে। কেন সরকার তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল না, সে প্রশ্ন আমাদের।
আইসিটি আইনে দণ্ডিত বা পলাতক আসামির সম্পত্তি ক্রোকের বিষয়ে কিছু বলা নেই। প্রচলিত আইনেও রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের সম্পত্তি ক্রোক বা বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। প্রচলিত আইনে এসব ক্ষমতা না থাকায় সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তবে প্রচলিত আইনে আসামিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করাসহ সম্পত্তি ক্রোকের বিধান আছে। আইসিটি আইনে তাও নেই। যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে কোন কোন আসামি সম্পত্তি বিক্রি করেছে, সেটা সরকার খুঁজে বের করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। প্রচলিত আইনে গ্রেফতার কোনো আসামি ইচ্ছা করলে কারাগারে বসেই কমিশনের মাধ্যমে তার সব সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন। নিবন্ধন আইনে বলা আছে, ‘খরচ দিলে বাড়িতে বা পছন্দের জায়গায় গিয়ে সংশ্নিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার জমি দলিল করে দিতে পারবেন’।
জানা গেছে, ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের অনেকে গোপনে সম্পত্তি বিক্রি করে দেশত্যাগ করে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আগে বা পরে এবং তদন্ত চলাকালে আরও অনেক যুদ্ধাপরাধী তাদের সম্পত্তি বিক্রি বা পরিবারের সদস্যদের নামে হস্তান্তর করে থাকতে পারে বলে ধারণা করছি আমরা। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের স্ত্রী-সন্তানদের রাজনৈতি নিষিদ্ধ ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রতিটি নাগরিকের সময়ের দাবী।
লেখক: সহ-সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটি।