(প্রথম পর্ব)
কাজী নজরুল ইসলাম সেই স্বর্গোদ্যানের ফুল; নীল অপরাজিতা। বেদনার রং নীল জন্মসূত্রেই জড়িয়ে ধরে নজরুলকে। কিন্তু সাহস ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অপরাজেয় হয়ে ওঠেন কবি। তাই তাঁকে আমি বলি বাংলা সাহিত্যের নীল অপরাজিতা। উত্থানপতনের নান্দনিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এই কবি ২৪ মে, ১৮৯৯ সালে (বাংলা– ১১ জৈষ্ঠ্য, ১৩০৬) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি কবি।
তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। (ফকির আহমেদ এর ২য় স্ত্রী জাহেদা খাতুন)। জাহেদা খাতুনের চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর নজরুলের জন্ম হয় বলে তাঁর নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। বাল্যকালে তাকে ‘ত্যারা ক্ষ্যাপা’ ও ‘নজর আলী’ নামেও ডাকা হতো। জীবনের টানাপোড়েনে হারানোর দুঃখ নিয়ে ভরপুর ওই পরিবারে প্রদীপ জ্বেলে হেসে ওঠা সেই নজরুল জীবনের নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এক পর্যায়ে হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি। সাহিত্যে তিনি ‘নুরু’ নামও ব্যবহার করেছেন।
এক হাতে প্রেমময় বাঁশি আরেক হাতে রণতূর্য নিয়ে আবির্ভূত হওয়া কবি তখনকার বাংলায় প্রচলিত শিল্পধারার বাঁক বদলে দিয়ে সাহিত্য ও সংগীতের অবস্থান করেছে সমৃদ্ধ। যার কারণে নজরুল বাংলার মানুষের শিল্প ও সাহিত্যের সেই ফুল হয়ে ওঠে, যার ঘ্রাণ এপার–ওপারের সকল বাঙালির হৃদয়ে তুলেছিল প্রণয়ী সুখের ঢেউ।
১৯১৯ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকার মে–জুন সংখ্যায় নজরুলের প্রথম রচনা/গল্প ‘বাউলের আত্মকাহিনী’ প্রকাশিত হয়। একই বছর তাঁর প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ পত্রিকার জুলাই–আগস্ট সংখ্যায়। এবং ‘সওগাত’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় (অক্টোবর–নভেম্বর)-এ প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা’।
১২ জুলাই, ১৯২০ সালে সান্ধ্য পত্রিকা ‘নবযুগ’ এর যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান কবি। তাঁর সাথে কমরেড মোজাফফর আহমদও ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে। এ.কে ফজলুল হক ছিলেন সেই ‘নবযুগ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকা প্রকাশিত হলে কাজী নজরুল ইসলাম তার সম্পাদক নিযুক্ত হন।
নজরুলের জীবনের নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সময়ের বাঁকে নজরুলের একনিষ্ঠ সঙ্গী ও বিশ্বস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত একসাথে ছিলেন কমরেড মোজাফফর আহমদ।
১৮ জুন, ১৯২১ সালে কবির দাম্পত্য জীবনের সূচনা হয়। সেই সময় পুস্তক ব্যবসায়ী গ্রন্থকার আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লার দৌলতপুরে তাঁর বাড়িতে যান। সেখানে অবস্থানকালে আলী আকবর খানের ভাগ্নের সাথে নজরুলের সখ্য গড়ে ওঠে। যা প্রেমের সম্পর্কে রূপ নেয়। তখন আলী আকবর খান তাঁর বোনের মেয়ে সৈয়দা খাতুনের সাথে কবির বিবাহ দেন। কিন্তু কাবিনের শর্তে মামা আকবর নজরুলকে ঘরজামাই থাকার শর্ত জুড়ে দেন। যা উড়নচন্ডী স্বাধীনচেতা নজরুল মেনে নিতে পারেন নাই। সেই চাপিয়ে দেওয়া শর্ত কোনভাবেই মেনে নিতে না পেরে কবি তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী সৈয়দা খাতুনকে রেখে বাসর রাতেই সেখান থেকে পালিয়ে যান। ভালোবাসার মানুষ হিসেবে হৃদয়ে সৈয়দা খাতুনকে মনে স্থান দিয়েছিলেন নজরুল। ভালোবেসে প্রিয় মানুষের ডাক নাম দিয়েছিলেন নার্গিস। সেদিন বাসর ঘর থেকে পালানোর পর নজরুল ছিলেন বেওয়ারিশ। তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নাই। নার্গিস তার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ করতে থাকে। কবি নিজের জীবনের এই গল্প থেকে বহু দূরে সরে গেছে ততদিনে। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ১৯৩৭ সালে নজরুল তাঁর নার্গিসকে একটি চিঠি লেখেন। নজরুলের এই রোমান্টিক প্রেম ও দাম্পত্য জীবনের সূচনালগ্নের কাহিনি নিয়ে কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী ‘নার্গিস’ নামে একটা উপন্যাস রচনা করেন। যেখানে নজরুলের এই প্রেমের গল্প সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কেবল বিদ্রোহ নয়, সমানতালে প্রেমের বংশীও বাজিয়েছেন নজরুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে প্রেমের আখ্যান নিয়ে বিশ্বজিৎ চৌধুরী রচিত ‘কবি ও রহস্যময়ী’ উপন্যাসও তার স্বাক্ষর।
তাঁর জীবনে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও ঘটে কুমিল্লায়। নার্গিসের সেই বাসর ঘর থেকে পালানোর পর নজরুল তাঁর কোনো খোঁজ না নিলেও কুমিল্লায় আসা–যাওয়া হতো কবির। বছর তিনেক পরে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে গিয়ে তিনি ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে থাকতেন। সেখানে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ভ্রাতুষ্পুত্রী, গিরিবালা দেবীর (বিরজাসুন্দরীর জা) কন্যা আশালতার সাথে নজরুলের প্রণয় জন্মে। যার পরিণতি হিসেবে ২৪ এপ্রিল, ১৯২৪ সালে নজরুল আশালতা সেনগুপ্তাকে বিয়ে করেন। আশালতার ডাকনাম ছিল ‘দুলি’, তাই তাকে আদর করে দোলন বা দুলু নামে ডাকা হতো। বিয়ের পর নজরুল তার স্ত্রীর নাম দেন প্রমীলা। সেই প্রমীলা দেবী–ই কবির সাথে জীবনের শেষ পর্যন্ত প্রেমময় সঙ্গী হয়ে ছিলেন। এবং স্ত্রীর নামের সাথে মিল রেখে কবি ‘দোলনচাঁপা’ শিরোনামের একটা রোমান্টিক কাব্যগ্রন্থও রচনা করেছেন।
জীবনের নানা ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্যেও তাঁর প্রতিভাকে বাংলা সাহিত্যের বুকে সমুজ্জ্বল প্রদীপের শিখার মতো চিরন্তন বাস্তব রূপ দিয়ে গেছেন। একে একে রচনা করেছেন কালজয়ী কবিতা, গল্প, উপন্যাস। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা প্রসঙ্গ ও বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা রচনা করেছেন ‘নজরুলের শিল্পসিদ্ধি ও বিদ্রোহী’ শিরোনামে পাঠ সমালোচনা গ্রন্থ। শিশু কিশোরদের কাছে নজরুলকে পৌঁছে দেওয়ার নিমিত্তে মুহম্মদ নূরুল হুদা রচনা করেছেন ‘ছোটদের নজরুল জীবনী’। নজরুলের উপলব্ধির মৌলিকত্ব ও অভিনবত্ব, তাঁর অভিব্যক্তির স্বতন্ত্র শৈল্পিক পরিশীলন এবং তাঁর বাণীসত্যের মানবিক নান্দনিকতা নিয়ে হুদা লিখেছেন ‘নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব’ নামে প্রবন্ধগ্রন্থ। নজরুলের বহুমাত্রিক গুণাবলির ব্যক্তিত্ব নিয়ে হুদার ইংরেজি রচনা ‘Nazrul: Anevaluation এবং কাজী নজরুলের কবিতাসমগ্রকে ‘Poetry of Kazi Nazrul Islam নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন নজরুল একাডেমির সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা।
পত্রিকার সাথে কাজ করা তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মোড়। তিনি ১৯২২ সালে অর্ধ–সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’ ও ১৯২৫ সালে ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ধূমকেতু পত্রিকাটির প্রকাশনা উপলক্ষে নজরুলকে আশীর্বাদ করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন–
‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু,
আয় চলে আয়রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যটি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যার পাতার শীর্ষে লেখা থাকতো।
ধূমকেতু পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২৩ নভেম্বর, ১৯২২ সালে প্রবন্ধগ্রন্থ ‘যুগবাণী’ নিষিদ্ধ হলে কবি গ্রেফতার হন এবং ১৬ জানুয়ারি, ১৯২৩ সালে এক বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। জেলে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করা হয়। তখন জেল কর্তৃপক্ষ তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে কবি নিজেকে বিদ্রোহী কবি উল্লেখ করে ৪ পৃষ্ঠার একটা প্রবন্ধ লেখেন। যা ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’ নামে প্রকাশিত হয়। ফলে নজরুলের অনুপস্থিতিতে বীরেন সেনগুপ্ত ও অমরেশ কাঞ্জিলালের সম্পাদনায় পত্রিকাটির কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হলেও মার্চ, ১৯২৩ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৫ অক্টোবর, ১৯২৩ সালে তিনি মুক্তি পান।