প্রবল গণআন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণের সম্ভাবনা নিয়ে গুঞ্জনের মধ্যে দেশটির ব্রিটিশ–বাংলাদেশি সংসদ সদস্য রুপা হক বলেছেন, তার সরকারের এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন হবে না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্যান্ডার্ডে এক নিবন্ধে যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনার আশ্রয় না দেওয়ার পক্ষে তার মত তুলে ধরেন তিনি। খবর বিডিনিউজের।
লেবার পার্টির সংসদ সদস্য রুপা হকের লেখাটি বৃহস্পতিবার দ্য স্ট্যাডার্ড প্রকাশ করেছে। লেখার শুরুতে তিনি ঐতিহ্যবাহী ব্যান্ডদল বিটলসের অমর শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ বিষয়ক গানের কথা তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ কতটা ‘বিশৃঙ্খল’ ছিল তা নিয়ে গেয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। গত সপ্তাহে তিনি আবার সঠিক প্রমাণিত হলেন। সাদ্দাম হোসেনের ক্ষমতাচ্যুতির মত ঘটনার প্রতিফলন দেখা গেল, জাতির পিতার ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়া হল, কুশপুতুল পোড়ানো হল, যা ঢাকা থেকে টাওয়ার হ্যামলেট (যুক্তরাজ্যের একটি পৌরসভা) পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনকে তিয়ানআনমেন স্কয়ারের সঙ্গে তুলনা করে রুপা হক লিখেছেন, ’স্বৈরাচারী’ কন্যা শেখ হাসিনা দেশটির আয়ুষ্কালের বড় অংশই শাসন করেছেন (সর্বত্র তার বাবার ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম স্থাপন নিশ্চিত করে)।
দ্য স্ট্যান্ডার্ডের লেখায় রুপ হকও তার বাংলাদেশ ভ্রমণের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। সদ্য বিদায়ী সরকারের আমলে ওঠা ভোট কারচুপি, ’গুম’ ও বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ নিয়েও কথা বলেছেন তিনি।
১৯৭২ সালে লন্ডনে জন্ম নেওয়া রূপা চার থেকে পাঁচবার পাবনায় এসেছেন বলে তার এক মামার কাছ থেকে জানা যায়। যুক্তরাজ্যের ৪ জুলাইয়ের সাধারণ নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মত লেবার পার্টি থেকে পার্লামেন্টের সদস্য হন পৈত্রিক সূত্রে পাবনার মেয়ে রূপা হক, যার জন্ম ১৯৭২ সালে লন্ডনের ইলিংয়ে।
ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসন থেকে জয়ী রূপা লেবার পার্টির সদস্য হন ১৯৯১ সালে। তিনি একাধারে লেখক, মিউজিক ডিজে, কলামিস্ট হিসেবে পরিচিত। পাবনা শহরের মকছেদপুরে রূপার দাদা বাড়ি, আর নানা বাড়ি শহরের কুঠিপাড়ায়। দাদা মনছের আলী ও নানা মুসা বিশ্বাস মারা গেছেন বেশ আগেই। আছেন তার মামা–চাচারা।
ছাত্রদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে লন্ডন, ম্যানচেস্টার, প্যারিস, রোমসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিক্ষোভের প্রসঙ্গ টেনে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম একই শাসনের বাইরে কিছুই জানতে পারেনি বা ব্যালট পেপারে বিকল্প প্রার্থীকেও পায়নি। গত জানুয়ারিতে একই কায়দায় নির্বাচনে জয়ী হন শেখ হাসিনা। রুপা হক লিখেছেন, অধিকাংশ মানুষ মনে করে শেখ হাসিনা শুধু শাড়ি পরা একজন সপ্ততিপরবৃদ্ধাই নন, ’বর্বর’ শাসকও। সারাদেশে জ্বালাও–পোড়াওয়ের মধ্যে তিনি ভারতে নির্বাসিত হন।
৫ অগাস্ট গণআন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে ভারত চলে যান শেখ হাসিনা, সঙ্গে ছিলেন তার ছোট বোন শেখ রেহানা। সেই থেকে তারা ভারতেই আছেন। ভারত থেকে শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যে যেতে পারেন– এমন খবর দিতে থাকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়েছেন বলেও খবর আসে। তবে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কোনো তথ্য দেয়নি।
রুপা হক লিখেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তার ব্যাপক অজনপ্রিয় শাসনামল ও অভিবাসনসংক্রান্ত রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার নিরিখে যুক্তরাজ্য সরকারের এমন একজনকে আশ্রয় দেওয়া সমীচীন হবে না, যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের দাবি রয়েছে। অনেক বাংলাদেশি মনে করে, তাকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।’
শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য। ৪ জুলাইয়ের নির্বাচনে তিনিও টানা চতুর্থবারের মত লেবার পার্টি থেকে জয়ী হন তিনি।। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে তার রাজনৈতিক সম্পর্ক বেশ মজবুত বলে খবর রয়েছে। এসব তথ্য সামনে এনে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলে আসছে, যুক্তরাজ্যে আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনা। ভারতীয় বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্সও এমন খবর প্রকাশ করেছে।
টিউলিপ সিদ্দিক ও রুপা হক যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সংসদ সদস্য। শেখ হাসিনার আশ্রয় চাওয়া, না–চাওয়ার বিষয়ে টিউলিপের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য আসেনি। তবে রুপা চান, তার সরকার যেন শেখ হাসিনাকে আশ্রয় না দেন।
ছাত্রদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে থাকা নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের প্রসঙ্গ টেনে রুপা হক লিখেছেন, জনপ্রিয়তার ভয়ে তাকে সমপ্রতি জেলে রাখার ব্যবস্থাও করেন তিনি (শেখ হাসিনা)। এরপর তার লেখায় ওঠে আসে খালেদা জিয়ার মুক্তি পাওয়ার ঘটনা। এসব ঘটনার মধ্যে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের যুক্তরাষ্ট্রে বসে বিবৃতি দিয়ে তার মায়ের ক্ষমতায় ফেরার বার্তার বিষয়টিও উঠে এসেছে রুপার লেখায়। বিরোধীদের ইসলামপন্থি হিসেবে চিত্রিত করে তাদের তুলনায় তার মাকে ‘সেরা’ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ এই ব্রিটিশ সংসদ সদস্যের। সেই সঙ্গে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার বার্তা দেওয়ারও সমালোচনা করেছেন তিনি। শেষে রুপা হক লিখেছেন, আমার বাংলাদেশি ভাই–বোনদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। সরকার নিয়ে কণ্ঠ তুললেই নিপীড়নের শিকার হওয়ার ভয়ের সংস্কৃতি আর নেই।
শেষে তিনি বলছেন, তবে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে: আশা করি সেখানে গণতন্ত্র ফিরবে। তবে পতিত শিবির বলছে, তারা স্থিতিশীলতা এনে দিয়েছিল। দুই পরিবারের চিরবৈরিতা যেখানে বাংলাদেশের ইতিহাস রূপায়ন করে, এবার যখন সত্যিকারের নির্বাচন আসবে, সেটিই হবে সব কিছু নতুন করে শুরু করার উৎকৃষ্ট সময়।