ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার যাওয়ার অপেক্ষায় বৃহত্তর চট্টগ্রামবাসী। এতো নদী–বন–পাহাড় এবং সবুজ অরণ্য পেরিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজার ট্রেন যাবে তা এতো কাল ছিল স্বপ্নের মতো। বছর, মাস পেরিয়ে সেই অপেক্ষাটা এখন মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার মাত্র। ঝিকঝিক শব্দে আরামদায়ক দুলুনিতে কর্ণফুলী–শঙ্খ–চুনতি অভয়ারণ্যসহ সাঙ্গু মাতামুহুরী পাড়ি দিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজার যাওয়ার অধীর আগ্রহ বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ সারাদেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের।
বহুল আকাঙ্ক্ষিত নব নির্মিত দোহাজারী–কক্সবাজার রেলপথে আগামী ১১ নভেম্বর ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে এই রুটে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলবে আগামী ৭ নভেম্বর। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ১১ নভেম্বর কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন শেষে আইকনিক স্টেশন দেখবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী সুধী সমাবেশে যোগ দেবেন বলেও জানান দোহাজারী–কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. সবুক্তগীন। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী মহেশখালী উপজেলা সদরে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায়ও বক্তব্য দেবেন। ১১ নভেম্বর উদ্বোধনের পর এই রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হবে ১ ডিসেম্বর থেকে। এ রুটে দুটি ট্রেন চালানোর প্রস্তাব থাকলেও, ঢাকা থেকে প্রথমদিকে দিনে একটি আন্তঃনগর ট্রেন চলবে। এটির সত্যতা নিশ্চিত করে মহাপরিচালক কামরুল আহসান জানিয়েছেন, পরবর্তী সময়ে এ রুটে ট্রেন বাড়বে। দোহাজারী–কক্সবাজার রেলপথের উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ স্থাপন হবে।
রেলওয়ে মহাপরিচালকের কার্যালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, দিনে একটি ট্রেন ঢাকা থেকে রাত সাড়ে ১০টায় যাত্রা করে বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রাম স্টেশনে বিরতি দিয়ে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে কক্সবাজারে পৌঁছাবে। কক্সবাজার থেকে দুপুর ১টায় যাত্রা করে রাত ৯টা ১০ মিনিটে ঢাকায় ফিরবে। ফিরতি পথেও চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করবে। মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে ট্রেনটির।
দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়েই ট্রায়াল রানের ট্রেনটি রোয়ালখালী, পটিয়া, দোহাজারী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চকরিয়া উপজেলা হয়ে কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশনে যাবে। এই ট্রায়াল রানে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন, রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীসহ বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও যাবেন।
প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ইতোমধ্যে ঢাকা–চট্টগ্রাম–কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথের জন্য একাধিক নতুন ট্রেন চালুর সময়সূচি এবং ট্রেনের ছয়টি নামের প্রস্তাব করে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয় থেকে ঢাকা রেল ভবনে পাঠানো হয়েছে। আগামী ৭ নভেম্বর রেলমন্ত্রী এসব ট্রেনের সময়সূচির ঘোষণা দেবেন।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ট্রেনে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে জানতে চাইলে প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন বলেন, এখন একটু সময় বেশি লাগবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার আমরা এখন পূর্ণগতিতে চালাব না। ৫০–৬০ কিলোমিটার গতিতে চালাব। মাস দুয়েক পরে ৮০ কিলোমিটার গতিতে চালাব। এখন হয়ত আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টা লাগবে। চট্টগ্রাম থেকে পরে সেটা ২ ঘণ্টায় করতে চাই।
বর্তমানে ট্রেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছাতে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টা সময় লাগে। সেই হিসাবে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যেতে ৭ ঘণ্টার মতো সময় প্রয়োজন হবে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী সুবক্তগীন বলেন, এ প্রকল্পের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমবারের মতো পর্যটন নগরীর সাথে সারাদেশের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে। এবং এটা পরবর্তীতে আমাদের মাতারবাড়িতে যে গভীর সমুদ্র বন্দর সেটার সাথেও রেল কানেক্টিভিটি হবে। চালু হতে যাওয়া রেলপথে যে চুনতি অভয়ারণ্য রয়েছে– সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বনাঞ্চলের ভিতর দিয়ে এই রেললাইন গেছে। আমরা চেষ্টা করেছি, যথাসম্ভব পরিবেশকে রক্ষা করতে। এখানে যে বন্য প্রাণী আছে, তারা যাতে অবাধে বিচরণ করতে পারে বনের একপাশ থেকে আরেক পাশে; সেজন্য এখানে হাতির জন্য আন্ডারপাস এবং ওভারপাস করা হয়েছে।
হাতি যে ধরনের খাদ্য খায়, তার পথে সে ধরনের গাছ লাগানো হয়েছে; যাতে হাতি সেই পথ দিয়ে চলাচল করে। এটা দীর্ঘদিন সিসিটিভিতে মনিটরিং করার পর ইন্টারন্যাশনাল এক্সপার্টরা ডিজাইন করেছেন। আমাদের জানা মতে, এশিয়াতে আর হাতির জন্য কোনো ওভারপাস বা আন্ডারপাস নেই। এটাই প্রথম।
প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন বলেন, কক্সবাজার যে রেলওয়ে স্টেশনটা, এটা আধুনিক একটা ভবন। স্টেশনের অপারেশন সুবিধা ব্যাপক হারে আছে। লিফট ও এস্কেলেটর আছে বৃদ্ধ, শিশু ও অসুস্থদের জন্য। ফুড কোর্ট, আবাসিক, যাত্রীদের জন্য লকার ব্যবস্থা সব কিছু রাখা হয়েছে।
পর্যটন নগরী কক্সবাজার গিয়ে একজন পর্যটককে আলাদা করে হোটেলে থাকতে হবে না। স্বল্প খরচে আইকনিক স্টেশন ভবনে লাগেজ রাখার লকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেখানে লাগেজ রেখে সারাদিন ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার চলে যেতে পারবেন। স্বল্প খরচে কেউ থাকতে চাইলে সেখানে থাকতেও পারবেন। ভালো মানের অপারেটর দিয়ে সেটি পরিচালনা করা হবে। কালুরঘাট সেতুর মেরামত কাজ বৃহস্পতিবারের (গতকাল) মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করা হয়েছে জানিয়ে সুবক্তগীন বলেন, কালকে সেখানে ট্রায়াল হবে।
কক্সবাজার রুটের ট্রেনের ৬টি নাম প্রস্তাব : ট্রেনটির ছয়টি নাম প্রস্তাব করেছে রেলওয়ে। এগুলো হলো, ‘প্রবাল এক্সপ্রেস’, ‘হিমছড়ি এক্সপ্রেস’, ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’, ‘ইনানী এক্সপ্রেস’, ‘লাবণী এক্সপ্রেস’ ও ‘সেন্টমার্টিন এক্সপ্রেস’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাম চূড়ান্ত করবেন।
ট্রেনে দুটি খাবার বগি, একটি পাওয়ার কার, তিনটি এসি কেবিন, পাঁচটি এসি চেয়ার, ছয়টি শোভন চেয়ার এবং একটি নন–এসি ফার্স্ট সিট বগি থাকবে। ঢাকা থেকে যাত্রার সময় আসন সংখ্যা হবে ৭৯৭টি। ফিরতি পথে আসন হবে ৭৩৭টি।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পরিবহন বিভাগ থেকে জানা গেছে, আপাতত ঢাকা–চট্টগ্রাম রুটের তূর্ণা নিশিথার বগি দিয়ে চালানো হবে ঢাকা–কক্সবাজারের ট্রেন। তূর্ণা নিশিথায় বিকল্প রেক দেওয়া হবে।
এদিকে বর্তমানে প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে দোহাজারী–কক্সবাজার রেল লাইনের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, ইতোমধ্যে প্রকল্পের রেল লাইন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ১০২ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক বসানো হয়েছে। আমাদের কক্সবাজার দৃষ্টিনন্দন আইকনিক স্টেশন বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ শেষ। আইকনিক স্টেশন বিল্ডিংয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোর এবং দ্বিতীয় তলা একেবারে রেডি। এখন থেকে অপারেশন কাজ চলবে। অপারেশন কাজের সকল ধরনের কার্যক্রম এখন থেকে চলবে। এদিকে দোহাজারী, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু স্টেশনে কাজ শেষ হয়েছে। আর কিছু স্টেশনের কাজ চলমান আছে। সেগুলোও এর মধ্যে চলবে।
কক্সবাজারসহ এ স্টেশনগুলোতে থাকবে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম। এখন স্টেশনগুলোতে জনবল নিয়োগের কাজ চলছে।
প্রকৌশলী মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, প্রকল্পের দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত এবং চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথে ৩৯টি ব্রিজ এবং আন্ডারপাসসহ ২৫১টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি রেলপথ নির্মাণের সময় অনেক গাছ কাটতে হয়েছে। সেগুলো পুষিয়ে নিতে প্রায় সাত লাখ গাছ রোপণ করা হবে। ইতোমধ্যে পাঁচ লাখ গাছ রোপণ করা হয়েছে। তিন বছর আগে আমরা যেসব গাছ লাগিয়েছি সেগুলোর উচ্চতা এখন তিন চার ফুট হয়েছে। আমলকিসহ অনেক ফলদ গাছে ফল ধরেছে। আপনারা রেলপথ দিয়ে গেলেই দেখতে পাবেন সবুজ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে এই রেলপথ চলে গেছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তাপস কুমার দাস আজাদীকে বলেন, কালুরঘাট সেতুর মেরামত কাজ শেষে আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) সেতুতে ইঞ্জিনের ট্রায়াল করার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি কাল অথবা পরশু ট্রায়াল হতে পারে। ৩০০০ সিরিয়ালের ইঞ্জিন (৯০ টন ওজন) দিয়ে এই ট্রায়াল করা হবে। এই সিরিয়ালের ইঞ্জিন দিয়ে দোহাজারী–কক্সবাজার নবনির্মিত রেল
লাইনে ট্রেনের ট্রায়ালসহ উদ্বোধনী ট্রেন চলবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তাপস কুমার দাস বলেন, ট্রেনের প্রতিটি এসি কোচের ওজন ৩৬ টন, নন এসি (শোভন চেয়ার) কোচের ওজন ৩২ টন, প্রত্যেক বগির এক্সেল লোড–৮–৯ টনের, প্রত্যেক ইঞ্জিনের এক্সেল লোড–১৫ টন। কক্সবাজার রোডে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমদানিকৃত ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনে ট্রেন চলাচল করবে।
এদিকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সেতু প্রকৌশলী জিসান দত্ত গতকাল আজাদীকে বলেন, কালুরঘাট সেতুতে আগে দশ টন এক্সেল লোডের ট্রেন চলাচল করতো। এখন বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিমের তত্ত্বাবধানে নতুন করে সংস্কার কাজ শেষে সেতুর ওপর দিয়ে ১৫ থেকে ১৬ টন এক্সেল লোডে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনে সেতুর ওপর ট্রায়াল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বুয়েটের টিম কিছু অবজারভেশন দিয়েছে। বুয়েটের টিমের সদস্যরা আজকেও (গতকাল) সারাদিন ছিলেন, সন্ধ্যায় তারা ঢাকায় চলে গেছেন। উনারা কিছু অবজারভেশন দেওয়ায় আজ (গতকাল) ট্রায়াল হয়নি। তিনি বলেন, সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলের উপযোগী হয়েছে। সেতুর উপর ট্রেন লাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এখন কক্সবাজার রুটের ট্রেন যেতে পারবে। আগামী ৭ নভেম্বর কক্সবাজার রুটের ট্রায়াল রান চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে সেতুর ওপর দিয়ে যাবে।