চট্টগ্রাম নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের যোগ্য বলে জানিয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। ইতোমধ্যে অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাড়িটি পরিদর্শন করে ভূমি নকশা প্রণয়নের কাজ শেষ করেছেন।
একশ বছরের বেশি বয়সী বাড়িটির প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক গুরুত্ব বিবেচনায় এটি পুরার্কীতি হিসেবে সংরক্ষণযোগ্য বলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক মোছা. নাহিদ সুলতানা জানিয়েছেন। বাড়িটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, অসহযোগ আন্দোলন, বার্মা অয়েল কোম্পানির আন্দোলন, চা শ্রমিকদের ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন এবং আসাম বেঙ্গল রেল ধর্মঘটের স্মৃতি বিজড়িত। খবর বিডিনিউজের।
বাড়িটিকে সংরক্ষণ করতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে আবেদন করেছিল চট্টগ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৫ জুলাই ভবনটি পরিদর্শন করেন অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালকের নেতৃত্বে একটি দল। ওই দলকে ভবনটির ইতিহাসসহ নানা বিষয়ে তথ্য দেন কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। সবশেষ বৃহস্পতিবার অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার চাইথোয়াই মারমা ভবনটির কাঠামো, কক্ষ ও ভূমির পরিমাপ করেন।
নাহিদ সুলতানা বলেন, ভবনটি পরিদর্শন করেছিলাম। প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক গুরুত্ব বিবেচনায় ভবনটি সংরক্ষণযোগ্য। সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণার সব বৈশিষ্ট্য ভবনটিতে বিদ্যমান। তিনি বলেন, কোনো স্থাপনা পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করতে হলে কমপক্ষে ১০০ বছরের পুরনো হতে হয়। এ ভবন শত বছরের বেশি পুরনো এবং এর স্থাপত্য রীতি ঔপনিবেশিক আমলের। এ সংক্রান্ত প্রাথমিক প্রতিবেদন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে পাঠাবেন জানিয়ে তিনি বলেন, এরপর আরো বেশ কিছু অফিসিয়াল কাজ আছে। সেগুলো হলে তারপর প্রস্তাবটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয় থেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে।
চট্টগ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আলীউর রহমান বলেন, সরকার ঐতিহাসিক এই ভবনটিকে প্রত্নসম্পদ হিসাবে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আশা করি দ্রুতই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত। চট্টগ্রামের এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। পরে যতীন্দ্রমোহন কলকাতার মেয়র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি দুপুরে যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়িটি দখল নিতে যান ব্যবসায়ী ফরিদ চৌধুরীর লোকজন। ফরিদ চৌধুরীর দুই ছেলে, স্থানীয় যুবলীগের নেতাকর্মী, ৪৫ জন পুলিশ সদস্য এবং চট্টগ্রাম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের নাজির আমিনুল হক আকন্দ দখল পরোয়ানাসহ কাগজপত্র নিয়ে সেদিন উপস্থিত ছিলেন। সেদিন বুলডোজার দিয়ে ভবনের সামনের অংশ ভেঙে ফেলা হয়। খবর পেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তখনকার প্রসিকিউটর এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। পরে প্রতিরোধের মুখে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসে ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সিলগালা করে দেয়।
সেদিন রানা দাশগুপ্ত দাবি করেছিলেন অপকৌশলে ওই জমি নিয়ে আদালতের আদেশ আনা হয়েছে। তিনি বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য সরকারে কাছে দাবি জানিয়েছিলেন। এরপর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই বাড়িটি ভাঙার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় চট্টগ্রামের একটি আদালত। আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ২৩ জানুয়ারি বাড়িটি দখলদার মুক্ত করে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সেদিন বাড়িটিতে ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থান’ লেখা একটি সাইনবোর্ডও দেওয়া হয়।
ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহনও ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। তিনি কলকাতার মেয়র হয়েছিলেন। ইংরেজ স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তাকে নিয়ে কিছু দিন ভবনটিতে ছিলেন তিনি। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় এই বাড়িতে এসেছেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীরাও এই বাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর হয়ে মামলা লড়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন। সেজন্য তিনি ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়েন। ১৯৩৩ সালে কারাগারে মৃত্যু হয় তার। নেলী সেনগুপ্তা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জের বাড়িটিতে ছিলেন। পরে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। ফিরে দেখেন বাড়িটি বেদখল হয়ে গেছে।
১৯ গণ্ডা এক কড়া পরিমাণ জমিটি পরে শত্রু সম্পত্তি ঘোষিত হয়। এর মধ্যে ১১ গণ্ডা ২ কড়া জমি ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামের এক ব্যক্তি। ১৯৭৫–এর পর নাম বদলে সেই ভবনে ‘শিশুবাগ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে ইছহাকের সন্তানরা স্কুলটি পরিচালনা করছিলেন।
বাড়িটি দখলের চেষ্টার পর জেলা প্রশাসকের পক্ষে ২০২১ সালে চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করা হয়। বাড়িটি রক্ষা এবং এটিকে সংরক্ষণের দাবিতে ২০২১ সালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ আন্দোলন করেছিল। জমির মালিকানা দাবি করে ব্যবসায়ী এম ফরিদ চৌধুরীর করা মামলায় তার পক্ষে যে ডিক্রি দেওয়া হয়েছিল, ২০২৪ সালের ১০ জুন চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. খায়রুল আমিন এক আদেশে তা বাতিল করেন।