মোবাইল ফোনের আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডিন্টিটি) নম্বর পাল্টে যাচ্ছে ১০০০ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। ভুয়া আইএমইআই নম্বর যুক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহৃত হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। বিভিন্ন সময়ে মোবাইল ফোনের আইএমইআই বদলানোর কাজে জড়িতরা ধরা পড়েছে নগরীতে। এবার চট্টগ্রামে এমন একজনকে ধরা হয়েছে যিনি এই কাজের জন্য নিয়েছেন বিদেশি প্রশিক্ষণ। শুধু তাই নয়, তাকে সহযোগিতার জন্য রয়েছে দুই বিদেশি! নগরীর পাহাড়তলী মৌসুমী আবাসিক এলাকায় গত বুধবার রাতে অভিযান চালিয়ে সরোয়ার হোসেন সুজন ওরফে শাহন (৩১) নামে এ যুবককে গ্রেপ্তার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। তথ্যপ্রযুক্তিতে স্নাতক এ যুবক আইএমইআই পাল্টানোর কাজে বিদেশি সফটওয়্যারও কিনেছেন। তার কাছ থেকে আইএমইআই বদল করা ৫২টি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) আব্দুল মান্নান মিয়া জানান, গ্রেপ্তার শাহন চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস) থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এ কারণে বিভিন্ন প্রোগ্রামিং নিয়ে তার জানাশোনা আছে। প্রথমে শখের বশে মোবাইল ফোনের আইএমইআই পরিবর্তন করলেও এখন এটিই তার পেশা। নগরীর অলংকার শপিং কমপ্লেক্সে তার একটি মোবাইল বিক্রির দোকানও আছে। তিনি মোবাইল চোর ও ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন কিনে সেগুলোর আইএমইআই পাল্টে নিজের দোকানে কিংবা অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করেন। শাহনের আইএমইআই পাল্টানোর কারবারের সঙ্গে পাকিস্তানি ও ইন্দোনেশিয়ার মোবাইল টেকনিশিয়ানদের সংযোগ পেয়েছে পুলিশ। শাহন মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করতে না পারলে তাদের (বিদেশি সহযোগীদের) সাথে যোগাযোগ করে সেগুলোর নম্বর পাল্টে ফেলেন। এজন্য তাদের ডলারে অর্থ পরিশোধ করেন তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদে শাহন জানায়, তিনি ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। শিক্ষকতাও করেছেন কিছুদিন। প্রোগ্রামিংসহ তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে ভালো ধারণা থাকায় একসময় তার আইএমইআই পাল্টানোর কৌশল শেখার আগ্রহ জন্মায়। ফেসবুকের মাধ্যমে বছর খানেক আগে তার সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার এক মোবাইল টেকনিশিয়ানের পরিচয় হয়। তার (বিদেশির) কাছ থেকে ৫০০ ডলারের বিনিময়ে শাহন একটি সফটওয়্যার ইনস্টল করে নেয় নিজের ল্যাপটপে। পাশাপাশি অনলাইনে প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন। এরপর পাকিস্তানি মোবাইল টেকনিশিয়ানের কাছ থেকেও একইভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নিজে কোনো আইএমইআই পাল্টাতে না পারলে তার দ্বারস্ত হয় শাহন। টিমভিউয়ার (স্ক্রিন শেয়ারিং) সফটওয়্যারের মাধ্যমে তাদের সাথে যুক্ত হয়ে মোবাইল ফোনের আইএমইআই পাল্টে নেয় শাহন।
পুলিশ বলছে, শাহন নিজে যেমন চোরাই মোবাইল সংগ্রহ করে আইএমইআই পাল্টিয়ে বেচত, তেমনই চোরাই মোবাইলের অনেক ক্রেতাও তার মাধ্যমে আইএমইআই পাল্টাত। এজন্য সে ফোনভেদে ১ থেকে ১৫ হাজার টাকা নিত। আইফোনসহ যেকোন দামি মোবাইল ফোনের আইএমইআই পাল্টানো শাহনের কাছে ছিল বাঁ হাতের খেল! দামি ফোনের বেশির ভাগ তিনি তার পরিচিত বিদেশি দুই মোবাইল টেকনিশিয়ানের মাধ্যমে করিয়ে নেন।
জিএসএম (গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল) বা ইউএমটিএস (ইউনিভার্সেল মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম) মোবাইল সেটে পনের বা সতের ডিজিটের একটি নির্দিষ্ট নম্বর থাকে। সেটটি যখন যে নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত হয়, আইএমইআই নম্বরটি সংশ্লিষ্ট নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। মোবাইল সেট কোনো কারণে হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে কিংবা সেট ব্যবহারকারী সম্পর্কে জানতে এ নম্বরটির প্রয়োজন হয়। সেট ও সিম অকার্যকর করে দিতেও এ নম্বরটি ব্যবহৃত হয়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, সামপ্রতিক সময় মোবাইল ফোনে নকল আইএমইআই নম্বরের পাশাপাশি আসল আইএমইআই নম্বর মুছে ফেলার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এতে করে বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করেও অপরাধীরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এছাড়া একই আইএমইআই নম্বর একাধিক মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেটে ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে। আইএমইআই নকল হওয়ায় মোবাইল ফোন সংক্রান্ত অপরাধ চিহ্নিত করতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অনেক সময় অপরাধীদের ধরতে তাদের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাও সম্ভব হচ্ছে না। নগরীতে শাহ আমানত মার্কেট, রেয়াজউদ্দিন বাজার, তামাকুমন্ডি লেইন, ব্যাংকক সিঙ্গাপুর মার্কেটসহ বিভিন্ন নামী বেনামী মার্কেটে নিম্নমানের এসব হ্যান্ডসেট বিক্রি হচ্ছে। আবার নিম্নমানের এসব সেটের খোলস পাল্টে নামী ব্র্যান্ডের খোলস লাগিয়ে বিক্রি করছে ব্র্যান্ড আইটেম হিসেবেও।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আইএমইআই নম্বরটি বিশ্বব্যাপী একটি হ্যান্ডসেটের জন্য একটিই তৈরি হয়। ফলে প্রকৃত নম্বর কখনই প্রতিস্থাপন করা যায় না। নকল নম্বরগুলো ভুয়া। এ ছাড়া চীন থেকে আসা নিম্নমানের হ্যান্ডসেটের আইএমইআই নম্বরও বসিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে ওই হ্যান্ডসেটের চেয়ে আইএমইআই নম্বর বেশি দামে বিক্রি করা যায়। আবার একই আইএমইআই নম্বর একাধিক হ্যান্ডসেটেও বসানো হয়। এর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে একই আইএমইআই নম্বরের একাধিক চায়না হ্যান্ডসেট উদ্ধার হয়েছে।