অনবরত লিখেই চলেছি আমরা সড়ক দুর্ঘটনা ও তার প্রতিরোধ প্রসঙ্গে। কিন্তু তা যেন কোনো কাজেই আসছে না। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে। গত ১১ মে দৈনিক আজাদীতে ‘মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি বাড়াচ্ছে প্রাণহানি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সড়ক–মহাসড়কে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলোর একটি বড় অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বেপরোয়া চালনা, মাত্রাতিরিক্ত গতি, আইন না মানা এবং চালকদের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা। লাইসেন্স বা দক্ষতা অর্জন ছাড়াই রাস্তায় মোটরসাইকেল নিয়ে বের হচ্ছেন অনেকে। বেপরোয়া গতি ও হেলমেট ব্যবহার না করার প্রবণতা বাড়াচ্ছে প্রাণহানি। দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যুব সমাজ। এখন যত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় মোটরসাইকেল আরোহীদের। চলতি বছর চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে সংঘটিত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে বুয়েটের বিশ্লেষণ বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো সবচেয়ে বেশি হচ্ছে পেছন থেকে ধাক্কায়। মোট দুর্ঘটনার ৪২ শতাংশই অন্য যানবাহন মোটরসাইকেলকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার ফলে ঘটছে। একইভাবে ১৪ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে মুখোমুখি সংঘর্ষে। আরো ১৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে। অন্যদিকে ওভারটেক করতে গিয়ে ১০ শতাংশ, সংঘর্ষে ৯ শতাংশ, সড়কের কোনো অবকাঠামোর সঙ্গে ধাক্কা লেগে ৩ শতাংশ, পার্ক করে রাখা যানবাহনকে ধাক্কা দিয়ে ২ শতাংশ ও ৬ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে অন্য কারণে।’
সড়কে এভাবে মর্মান্তিক মৃত্যুই যেন নিয়তি এখন। ফলে সড়কপথে ভ্রমণ করা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো–চালকের অদক্ষতা, চালকের ক্লান্তি, গাড়ির বেপরোয়া গতি এবং গাড়ির ফিটনেস না থাকা। সাধারণের মনে এখন একটাই প্রশ্ন–মহাসড়ক নিরাপদ হবে কবে? গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া চালকের দক্ষতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে। মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ করতে হবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘দুর্ঘটনা নিয়ে আমাদের দুর্ভাবনা চলছেই। এই দুর্ঘটনার শেষ নেই। এখানে থ্রি হুইলার, মোটরসাইকেলের বেপরোয়া ড্রাইভিং সবকিছু মিলিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটছে। এজন্য নিরাপদ সড়ক প্রকল্প দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। যদি শীতল মনোভাব নিয়ে থাকি দুর্ঘটনা হতেই থাকবে। এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।’
সারাদেশের সড়কে কোন গাড়ি সর্বোচ্চ কত গতিতে চলতে পারবে, তা নির্ধারণ করে দিলেও কেউ তা অনুসরণ করছে বলে মনে হয় না। সড়কে সবচেয়ে আলোচিত মোটরযান মোটরসাইকেল চালানোর গতি সড়কের মান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা সদর ও শহর এলাকায় মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। একইভাবে যাত্রীবাহী গণপরিবহন, পণ্যবাহী যান, ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবার জরুরি পরিস্থিতিতে সব গাড়ির ক্ষেত্রে আইন শিথিল থাকবে বলেও জানানো হয়েছে।
ইতোপূর্বে আমরা পাঠকদের অবগতির জন্য জানিয়েছি যে, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন কিছু সুপারিশ পেশ করেছে। সংগঠনটি বলছে, দক্ষ চালক তৈরি উদ্যোগ বৃদ্ধি, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি, যানবাহন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও পথচারীদের মধ্যে ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কের স্বল্প গতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে সেগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা তৈরি, সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, গণপরিবহনের চাঁদাবাজি বন্ধ, রেল ও নৌপথ সংস্কার এবং সমপ্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমানো, টেকসই গণপরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা এবং সড়ক পরিবহন আইন–২০১৯ বাস্তবায়ন করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। তবে ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহন ও মোটরসাইকেলের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।