মোটরবাইকের বেপরোয়া গতির কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ। অনেকে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। বেঁচে যাওয়াদের সুস্থ হতে তিন সপ্তাহ থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসরা বলছেন, মোট সড়ক দুর্ঘটনায় চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় ৪২ শতাংশই মোটরবাইকের চালক নয়তো আরোহী। অনেকের হাত–পা কেটে ফেলতে হয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক মোটরবাইক বাজারে আসছে। একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাইক চালাতে গিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ছেন এবং দুর্ঘটনার অনুঘটক হিসেবেও কাজ করছেন। নগরীর রাস্তাগুলোতে যানজটেও রাখছেন ভূমিকা। বাইকের কারণে কমে যাচ্ছে অন্য সব যানের গতিও। বিশেষ করে সিগন্যাল উপেক্ষা করে ছোটেন শত শত মোটরবাইকার। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি মোটরবাইক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এবং চালক ও এর আরোহী মারাও গেছেন।
ট্রাফিক বিভাগ থেকে সংগৃহীত তথ্যমতে, গত তিন মাসে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় মোটরসাইকেল সংক্রান্ত দুর্ঘটনায় ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মোটরবাইকার নিহত হয়েছেন ১৮ জন। আরোহী ৫ জন। আর মোটরবাইকের ধাক্কায় মারা গেছেন ৬ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, গতির নেশার লাগাম পরিবার থেকেই টানতে হবে।
পুলিশের ট্রাফিক বিভাগও বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে মোটরবাইকের আধিক্য ঘটেছে। তা নিয়ন্ত্রণে আনা এখন তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। মোটরবাইকের কারণে রাস্তা এখন ঝুঁকির মুখে। গত কয়েকদিনে নিউ মার্কেট মোড়, জিইসির মোড়, কাজীর দেউড়ি, সিআরবি, গোলপাহাড় মোড়, চট্টগ্রাম কলেজ সড়ক, আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার, আগ্রাবাদ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব সিগন্যালে মোটরবাইকাররা ওঁত পেতে থাকেন ক্রসিং অতিক্রম করার জন্য। তাদের মধ্যে সিগন্যাল মানার প্রবণতা কম। সুযোগ পেলেই দ্রুত সিগন্যাল ডিঙিয়ে ছোটেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই নিয়ন্ত্রণ না করলে ভবিষ্যতে বিরাট খেসারত দিতে হবে।
এ বিষয়ে মহানগর পুলিশের উপ–কমিশনার (ট্রাফিক পশ্চিম) তারেক আহমেদ আজাদীকে বলেন, ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং যানবাহন নিয়ন্ত্রণে আমাদের একটা সার্বিক অ্যাপ্রোচ আছে। এটি মোটরবাইকের ক্ষেত্রেও। তবে সম্প্রতি শহরে মোটরবাইকের আধিক্য বেড়েছে এবং তারা অনেক সময় সিগন্যাল লঙ্ঘন করে তড়িঘড়ি পার হতে চায়। এখন মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণ করাটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গণপরিবহনের অপ্রতুলতা ও যানজট এড়িয়ে চলতে গত কয়েক বছর থেকেই মোটরবাইকে ঝুঁকছেন যাত্রীরা। প্রতিদিন দেশে গড়ে ১,০৩৫টি মোটরবাইক রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হচ্ছে। তবে যারা এসব মোটরবাইক চালাচ্ছেন তাদের একটি বড় অংশের লাইসেন্স নেই। মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে যখন অন্য সব গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে তখনও দেখা যায় ফঁাঁকফোকর দিয়ে মোটরবাইক চালকরা দিব্যি বেরিয়ে যান। এ ধরনের বেপরোয়া চালকদের সিগন্যালে থামিয়ে রাখতে অনেক জায়গায় বাধ্য হয়ে দড়ি দিয়ে রাস্তা আটকাতে দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশকে।
জানা গেছে, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মোটরবাইকের অধিকাংশেরই চালক অনভিজ্ঞ এবং লাইসেন্সবিহীন। নিয়ম না জেনে ইচ্ছেমতো বেপরোয়াভাবে চালান অনেকে। চালানোর সময় আবার অনেক চালকের কানে দেখা যায় মোবাইল বা ব্লুটুথ। ইতোমধ্যে বিআরটিএর পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি জারী করা হয়েছে, ন্যূনতম শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যতিরেকে কোনো ক্রেতার নামে মোটরবাইক রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হবে না।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মোটরবাইক দুর্ঘটনার ১০টি কারণ আমরা চিহ্নিত করেছি। সেগুলো হলো, কিশোর–যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, দেশে অতি উচ্চগতির মোটরসাইকেল ক্রয় ও ব্যবহারে বাধাহীন সংস্কৃতি ও সহজলভ্যতা, ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির শিথিলতা, চালকদের অদক্ষতা ও অস্থিরতা, সড়ক–মহাসড়কে ডিভাইডার না থাকা, সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা না থাকা, পারিবারিকভাবে সন্তানদের বেপরোয়া আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের বেপরোয়া মোটরবাইক চালানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক নিরাপত্তার কথা সরকার বলছে। অন্যদিকে মোটরবাইকের সিসি বাড়ানো হচ্ছে। আমরা সড়ক দুর্ঘটনার যে রিপোর্টগুলো পড়ছি সেখানে দেখা যাচ্ছে, ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মোটরবাইকই দায়ী।