‘মোখা আইয়ের, সাবধান।’ অর্থাৎ ‘মোখা আসছে, সাবধান’। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাব্য সময় ঘনিয়ে আসায় গতকাল শনিবার এভাবে একে অপরকে সতর্ক করেন চট্টগ্রামবাসী। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, পূর্ব–মধ্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড়টি আজ রোববার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে কক্সবাজার–উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এছাড়া গত মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগের প্রভাব শুরু হওয়ার কথা। এর আগে গতকাল দুপুরে কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এছাড়া চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসমূহকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ তিন পার্বত্য জেলায় ভারী বর্ষণ ও পাহাড় ধসের সতর্কতা জারি করা হয়।
‘মোখা’ আঘাত হানলে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে চট্টগ্রাম–কক্সবাজারের ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন। গতরাত সাড়ে ১১টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রায় ৮০ হাজার লোককে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার কথা জানায় জেলা প্রশাসন। এছাড়া কক্সবাজারে গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ১ লাখ ৮৭ হাজার লোক নিরাপদে আশ্রয় নেয় বলে স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। আবহাওয়া অফিস জানান, গতকাল সন্ধ্যা ৬টার সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে ঘণ্টায় বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ১৮০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। এছাড়া উপকূলীয় জেলা ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
ভারতীয় আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, রোববার (আজ) দুপুরের দিকে শক্তি কিছুটা কমিয়ে মোখা অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কাউকপুরের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ–পূর্ব বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানতে পারে। ওই সময় ঝড়ের গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১৫০–১৬০ কিলোমিটার। সর্বোচ্চ বেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১৭৫ কিলোমিটার। কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ গত রাতে জানান, আজ (গতকাল) বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টার সময় ঘূর্ণিঝড় মোখার বাতাসের গতিবেগ পাওয়া গেছে ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার। দমকা হাওয়ার গতিবেগ ঘণ্টায় ২৯৬ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড়টির চলার গতিবেগ গত দুইদিনের গতিবেগ অপেক্ষা দ্বিগুণ হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টার সময় ঘূর্ণিঝড়ের চলার গতিবেগ পাওয়া গেছে ঘণ্টায় ২২ কিলোমিটার। রাত ৩টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রবর্তী অংশ সেন্টমার্টিন দ্বীপে আঘাত হানার প্রবল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ‘মোখার’ ব্যাস ৫৫০ কিলোমিটার। গত ৭ মে রাতে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর ও তদসংলগ্ন দক্ষিণ আন্দামান সাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। যা ৮ মে রাতে সুস্পষ্ট লঘুচাপে এবং ৯ মে নিম্নচাপে পরিণত হয়। ১০ মে সকালে আরো শক্তিশালী হয়ে তা গভীর নিম্নচাপে এবং ১১ মে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।
উল্লেখ্য, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপ। এ অঞ্চলের ১৩টি দেশের দেওয়া নামের তালিকা থেকে পর্যায়ক্রমে নতুন নতুন ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করা হয়। ‘মোখা’ নামটি ইয়েমেনের দেয়া।
ভারী বর্ষণ ও পাহাড় ধসের ঝুঁকি : ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড় ধস হতে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে রাজধানীর আগারগাঁওস্থ আবহাওয়া অধিদপ্তরে ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র। সংস্থাটির আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা এর প্রভাবে আজ (গতকাল শনিবার) সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। ভারী বর্ষণের প্রভাবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমি ধস হতে পারে।
চট্টগ্রাম থেকে কত দূরে : গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬০৫ কিলোমিটার, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫২৫ কিলোমিটার এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল মোখা। এর আগে দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম থেকে ৭০৫ কিলোমিটার, কক্সবাজার থেকে ৬৩০ কিলোমিটার এবং পায়রা থেকে ৬৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল ঘূর্ণিঝড়টি।
সুপার সাইক্লোনে রূপ নেবে? : ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার অতিক্রম করলে তাকে ‘সুপার সাইক্লোন’ বলা হয়। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার কেন্দ্রস্থলে বাতাসের গতিবেগ ছিল ১৮০ কিলোমিটার। ওই হিসেবে মোখাকে সুপার সাইক্লোন বলা যাবে না। দেশের আবহাওয়া বিভাগও মোখা সুপার সাইক্লোনে রূপ নেবে না বলে জানায়।
গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, প্রথমে আশঙ্কা করা হয়েছিল এটি (মোখা) সুপার সাইক্লোন হতে পারে। আমরা এখন পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছি যে, এটা সুপার সাইক্লোন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ সুপার সাইক্লোন হতে গেলে বাতাসের গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার থাকতে হবে। কিন্তু এখন বাতাসের গতিবেগ ১৫০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার। এটাকে আমরা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বা ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোন হিসেবে অভিহিত করছি।
তবে কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ গতকাল একটি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, স্থলভাগে আঘাতের ছয় ঘণ্টার কম সময় আগে ঘূর্ণিঝড়টির সুপার সাইক্লোনে পরিণত হতে পারে।
আমেরিকার নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের তথ্য মতে, গত রাত ৯টায় অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বাতাসের গতিবেগ ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার হলে সেটি সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়। ৮৮ থেকে ১১৭ পর্যন্ত প্রবল ঘূর্ণিঝড়, ১১৭ থেকে ২২০ কিলোমিটার বেগে বইলে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং বাতাসের গতি ২২০ কিলোমিটার পার হলে তাকে সুপার সাইক্লোন বলা হয়।
ক্ষয়–ক্ষতি কেমন হতে পারে : আবহাওয়াবিদরা মোখার শক্তিকে তুলনা করছেন ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত করা ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ এর সঙ্গে। ওই সময় মারা যান সাড়ে তিন হাজার মানুষ। এছাড়া বাংলাদেশের প্রায় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। নষ্ট হয়ে যায় ২১ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। মারা যায় ২ লাখ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু এবং হাঁস–মুরগী।
গতকাল দুপুরে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংবাদ সম্মেলনে আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এটি (মোখা) সিডরের মতোই শক্তিশালী। প্রায় সিডরের সমতুল্য গতিবেগ নিয়ে সে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। তবে পার্থক্য হলো সিডর বাংলাদেশের মাঝ বরাবর দিয়ে গিয়েছিল, মোখা যাচ্ছে পাশ দিয়ে।
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ জানান, মোখার কেন্দ্রের পুরোটা কক্সবাজার জেলার উপর দিয়ে অতিক্রম করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপন্ন। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে বন্যা, ভূমিধস ও প্রাণহানির আশংকা রয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের বড় একটি অংশ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকা করছি। সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূ–কাঠামোর স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার আশংকা করছি। সেন্টমার্টিন দ্বীপে আটকে পড়া মানুষদের প্রাণহানির আশংকা রয়েছে, যদি সেখানকার সকল মানুষের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা না হয়।
এদিকে দুর্যোগ সতর্কতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ডিজাস্টার অ্যালার্ট অ্যান্ড কো অর্ডিনেশন সিস্টেম (জিডিএসিএস) ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। এছাড়া এ মুহূর্তে বিশ্বে চলমান দুর্যোগগুলোর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় মোখাকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে জিডিএসিএস।
মোখার প্রভাবে চট্টগ্রামে বৃষ্টি : অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে গতকাল চট্টগ্রামে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা বিশ্বজিত চৌধুরী জানান, গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নগরে ২ দশামক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে।