মেশিন লার্নিং ও ২০২৪-এর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার

অনুপ দাশগুপ্ত | রবিবার , ২০ জুলাই, ২০২৫ at ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

আমরা এখন বাস করছি বদলে যাওয়া পৃথিবীতে। যন্ত্র যখন মানুষের মতো আচরণ করতে পারে এবং মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে তখন কী বলা যায় না বিজ্ঞানীরা পৃথিবীকে বদলিয়ে দেয় নি? বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা ও প্রাণান্তকর গবেষণার ফসল আজ আমরা ভোগ করছি নির্দ্বিধায়। প্রত্যহের যাপিত জীবন এখন আগের চেয়ে বেশি গতিশীল ও আরাম আয়েশে ভরপুর। বিজ্ঞান এখন উন্নতির চরম শিখরে। আর এই চরম শিখরে অবস্থানের সবচেয়ে বড়ো অবদান হলো ফলিত পদার্থবিজ্ঞানের। একটা সময় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্ব আবিষ্কার ও তাঁর বহুল ব্যবহারের ফলে কম্পিউটার ও রকেট সায়েন্সের উন্নতি হয়েছিল বহুলাংশে। আর এখন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভেল্কি নয়, নোবেল পুরস্কার নেমে এলো মাটির পৃথিবীতে। ২০২৪ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল, এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেওয়া হয়েছে। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত দু’জন হলেন, জন হপফিল্ড এবং জেফরি হিন্টন। ওঁরা ২০২৪ এর নোবেল পেলেন ‘মেশিন লার্নিং’এর জন্য। এর সাথে একক সূত্রে বাঁধা আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই।

হপফিল্ড আছেন নিউ জার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর হিন্টন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদুজন মেশিন লার্নিংএর প্রথম সারির বিজ্ঞানী। মেশিন লার্নিং আয়ত্ব করার জন্য প্রথমে ‘আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক ’ শিখতে হয়।

সুইডেনের কার্লস্টাড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যালেন মুনস পদার্থবিদ্যায় নোবেল কিমিটির চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, “আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক যথেষ্ট কষ্টকর। সেখানে এই দুই বিজ্ঞানী সফল হয়েছেন বলেই আজ ‘মেশিন লার্নিং’ এর পথে এই বিশ্ব যেতে পেরেছে এবং ব্যবহারিক বিজ্ঞানের নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যা মানব সভ্যতাকে আরো বহু ধাপে এগিয়ে নিয়েছে।”

মেশিন লার্নিং’ আসলে কী? বার বার একই জিনিস দেখেশুনে শিশুরা যেমন শেখে, তেমনই নানা তথ্য বার বার দেখিয়ে যন্ত্রকে শেখানো হয়। তাকেই বলে ‘মেশিন লার্নিং’। পরে অজানা তথ্যের ক্ষেত্রেও যন্ত্র কাজে লাগাতে পারে সেই জ্ঞান। সেই যন্ত্রকে শেখাতে ‘কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক’ ব্যবহার করা হয়। মানবমস্তিষ্কে নিউরোন জুড়ে যেমন স্নায়ুতন্ত্র তৈরি হয়, সেই ধাঁচে কৃত্রিম ‘নিউরাল নোড’ জুড়ে তৈরি হয় ‘নিউরাল নেটওয়ার্ক’। যন্ত্রকে শেখানো একটি বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ। সেটাই তারা করেছেন।

বিজ্ঞানী হিন্টন ২০০০ সালে ‘নেচার নিউরো সায়েন্স’এ যেমন লিখেছিলেন, ‘শক্ত কাজ, এ ব্যাপারে সফল কিনা তা বলা যায় না’। হিন্টন যে কজনের উদ্ধৃতি লিখেছিলেন, তার মধ্যে এক নম্বরে ছিল বিজ্ঞানী হপফিল্ডের রচনা।

হপফিল্ড আর হিন্টন কৃত্রিম ‘নিউরাল নেটওয়ার্ক’ বানাতে কাজে লাগিয়েছেন পরিসংখ্যানের পদার্থবিদ্যার মৌলিক ধারণাকে।

হপফিল্ড এমন মডেল তৈরি করেছিলেন, যা তথ্য জমা করে রাখার পাশাপাশি, পূনর্গঠনও করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘জেনারেটিভ মডেল’কে প্রাথমিক রূপ দেন হপফিল্ডই। এর নাম দেন ‘হপফিল্ড নেটওয়ার্ক’ মডেল। আর ‘হপফিল্ড নেটওয়ার্ক’কে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানী হিন্টন উদ্ভাবন করেন ‘বোল্টজম্যান মেশিন’ যার সাহায্যে স্বাধীন ডেটার মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে যন্ত্রও। বর্তমানে ব্যবহৃত নিউরাল নেটওয়ার্কগুলির নেপথ্যে রয়েছে এই জুটির গবেষণা ও উদ্ভাবন।

হপফিল্ড কাজ শুরু করেন ১৯৮২ সালে। তখন তিনি এটাসেটা কাজ করতেন। তারপর ‘আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক’। হিন্টন এবং হপফিল্ড একসঙ্গে কাজ শুরু করেনছিলেন ১৯৯২ সালে। এক সাক্ষাৎকারে হিন্টন বলেন, ‘এখন গবেষকেরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি আরো আকৃষ্ট হবেন। যত্রতত্র এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ( এআই) ব্যবহার হচ্ছে। কিংবদন্তি দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভ যে দিন নতজানু হয়েছিলেন আইবিএম মেশিনের কাছে, সেদিন থেকেই মেশান ইন্টেলিজেন্সের যুগ শুরু হয়েছিল’।

বিজ্ঞানী হিন্টনের সতর্কবার্তাও আছে এরকম, ‘এআইয়ের এই প্রসারকে সে যুগের শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না, শুধু তফাত হল, সে সময়ে শারীরিক কর্মক্ষমতায় মানুষকে ছাপিয়ে গিয়েছিল যন্ত্র। এখন ছাপিয়ে যাবে বুদ্ধিমত্তাতেও। আমার বিশ্বাস, শীঘ্রই মানুষকে হারিয়ে দেবে কম্পিউটার। তবে প্রযুক্তি অভিশাপও হয়ে উঠতে পার!’ এআই এখন কোন কাজে না লাগছে? রিচার্স পেতে কেউ নকল করে প্রজেক্ট জমা দিয়েছেন কিনা সে কাজেও এআই লাগছে। ফলে এআইয়ের ব্যব্যবহার যত বাড়বে হপফিল্ড ও হিন্টনের এই উদ্ভাবনের গুরুত্ব তত বাড়বে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন কথোপকথন চালাতে পারে ছবি আঁকতে পারে, রোগ নির্ণয়সহ নানা কাজ করতে পারে। কিন্তু এসব কীভাবে করে এআই? উত্তর হলো মেশিন লার্নিং। আগেই বলেছি মেশিন বা যন্ত্রের শেখার প্রক্রিয়ার নামই মেশিন লার্নিং। এজন্য এআইকে অনেকগুলো উদাহরণ দেওয়া হয়। সেগুলো বিশ্লেষণ করে প্রোগ্রামটি নিজে নিজেই শিখে নেয় যে কীভাবে কী করতে হবে। আমরা একেই বলি এআই। যন্ত্রের শেখার বিশেষ পদ্ধতি আছে, যার মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কের কর্মপদ্ধতি নকল করতে পারে। একে বলে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক। মস্তিষ্কের কোষকে বলে নিউরন। শতকোটি নিউরন পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বুদ্ধিমত্তা ও স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গড়ে তোলে। কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কে মস্তিষ্কের নিউরনের আদলে তৈরি করা হয় একেকটি নোড্তনেটওয়ার্কের একক প্রতিটি অংশ। নোডগুলোর মধ্য দিয়ে সংকেত যাচ্ছে কিনা, তার ভিত্তিতে এদের মধ্যকার সংযোগ শক্তিশালী বা দুর্বল হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হপফিল্ড এমন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন, যা প্যার্টার্ন সংরক্ষণ ও সে অনুযায়ী নতুন প্যার্টান তৈরি করতে পারে। এর নাম ‘হপফিল্ড নেটওয়ার্ক’। এই নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য তিনি পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলো কাজে লাগিয়েছেন। এই নেটওয়ার্ক চেষ্টা করে, সর্বনিম্ন শক্তির অবস্থায় থাকতে। ধরুন, এতে একটা ঝাপসা বা অসমাপ্ত ছবি দেওয়া হলো। নেটওয়ার্কটি নানা রকম পিক্সেল মিলিয়ে পুরো নেটওয়ার্কের শক্তি যে পিক্সেলের জন্য সর্বনিম্ন হয়, তা বেছে নেবে। এভাবে ধাপে ধাপে বারবার নতুন পিক্সেল তৈরি করে, তা সঠিক জায়গায় বসিয়ে ঝাপসা বা অসমাপ্ত ছবিটিকে সম্পূর্ণ ছবিতে রূপান্তর করে এটি। অধ্যাপক জেফরি হিন্টনও এই হপফিল্ড নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নতুন এক ধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। গুণী বিজ্ঞানী ও গবেষক জন জে হপফিল্ড জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৩ সালের ১৫ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং আরেক গুণী বিজ্ঞানী জিওফ্রে ই হন্টন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে।

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার আজ একেবারে ‘এআইুভিত্তিক’ আবিষ্কারের জন্য যা প্রমাণ করে, এআই আজ বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ভাষা এআই এর দ্রুত অগ্রগতির ফলে এটি অনুবাদে, স্থানীয় ভাষায় এবং শিক্ষায় ব্যাপক সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। আগামী দিনগুলোতে এআই প্রযুক্তি বাংলা, সংরক্ষিত ও আদিবাসী ভাষার ক্ষেত্রে আরও বড় অবদান দিতে পারবে তবে এতে মানবিক ও নৈতিক দিকও আন্তরিকভাবে বিবেচনার প্রয়োজন।

লেখক: প্রবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ