টানা দ্বিতীয়বারের মতো নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দেশের হয়ে আলো ছড়ালো পাহাড়ের বীর কন্যারা। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের হয়ে ধরে রেখেছে চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুটও।
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা খেলোয়াড় হলেন বাংলাদেশের ফরোয়ার্ড ঋতুপর্ণা চাকমা। বাংলাদেশের অ্যাটাকিং এই মিডফিল্ডার পুরো টুর্নামেন্টজুড়েই দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন। আর ভরসার গ্লাভসজোড়া দিয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণ সামলে নিয়েছেন গোলরক্ষক রূপনা চাকমা। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে তিনি বাংলাদেশের আস্থার প্রতীক ছিলেন। ২০২২ সালের সাফেও তিনি টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক হয়েছিলেন। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক রূপনা চাকমার বাড়ি রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ভূঁইয়াদাম গ্রামে। গতকাল সকালে ভূঁইয়াদাম গ্রামে বাঁশের সাঁকো পাড়ি দিয়ে দেখা যায় রূপনা চাকমার বাড়িতে যাওয়ার জন্য রাস্তা নেই। তবে ২০২২ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সরকারের উদ্যোগে মাউরুম ছড়ার ওপর ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে। ছড়া ঘেঁষে আঁকা–বাঁকা ঢালু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে রূপনার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রুপনার মা কালাসোনা চাকমা ২০২২ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর উপহার পাওয়া নতুন ঘরের সামনের ক্ষেতে কাজ করছেন। তার চোখে মুখে যেন মেয়ের বিজয়ের উচ্ছ্বাস। তার ঘরে রাখা রয়েছে রূপনার বিভিন্ন খেলায় অর্জনের মেডেল, ট্রফিসহ নানা সম্মাননা স্মারক ও সনদপত্র।
এ সময় রূপনার মা কালাসোনা চাকমা বলেন, রাঙামাটি থেকে আমাদের এক আত্মীয় ফোন করে বলেছে রুপনাদের খেলা চলতেছে দেখার জন্য। আমি আমার ভাগিনাকে ডেকে তার মোবাইলে মেয়ের খেলা দেখেছি বাড়ির উঠানে বসে। তারা যখন গোল দিয়ে জিতলো তখন একজন মা হয়ে এত ভালো লেগেছে তা বলে বুঝানো যাবে না। আমার মেয়ের নাম এখন পুরো বাংলাদেশের মানুষ জানতেছে, পুরো দেশের মানুষ দেখেছে। আমার মেয়েরা আবারও বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করে দিয়েছে। এর থেকে বড় আনন্দ আর গর্বের কী আছে। তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ে খেলাধুলা করে বাংলাদেশের সুনাম করে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা তো সারা জীবন খেলাধুলা করে করে বাঁচতে পারবে না, আর কাজ করেও খেতে পারবে না। তার একটা চাকরি দরকার। আগের সরকার তো নতুন ঘর করে দিয়েছে ব্রিজও হয়ে যাচ্ছে। এখন যেহেতু সরকার বদল হয়েছে নতুন সরকার এসেছে, নতুন সরকারে কাছে দাবি থাকবে আমার মেয়েকে যেন একটা চাকরি ব্যবস্থা করে দেয়া হয় এবং সেই সাথে আমাদের বাড়িতে আসার রাস্তাটাও যেন করে দেওয়া হয়। কারণ মেয়েটা বাড়িতে আসলে রাস্তা না থাকায় চলাফেরা করতে খুব কষ্ট হয়। আগে ব্রিজ না হওয়ায় পারাপার হতে কষ্ট হতো। এখন ব্রিজটা যেহেতু হয়ে যাচ্ছে এবার আমাদের বাড়িতে আসার রাস্তাটাও যেন হয় এবং মেয়েটার যেন একটা চাকরি হয় এটা নতুন সরকারে কাছে আমার দাবি।
এদিকে, ভূঁইয়াদাম গ্রামের স্থানীয় যুবক মিকেশ্বর চাকমা বলেন, রূপনার ছোটবেলা থেকে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলায় আগ্রহ ছিল। আমাদের সাথে সে মাঝে মাঝে ক্রিকেটও খেলতো। এভাবে আমাদের গ্রাম থেকে সে দেশ পেরিয়ে বিদেশে গিয়ে খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে শুনতেও ভালো লাগে। এটা আমাদের গ্রামের জন্য অনেক বড় একটা অর্জন।
নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশের ফাইনালে জয়ের নায়ক ঋতুপর্ণা চাকমার বাড়ি রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের দুর্গম মগাছড়ি গ্রামে। তাদের বাড়ির যাওয়ার জন্য নেই কোনো ভালো রাস্তা। ধানক্ষেত দিয়ে ঘণ্টাখানেক হেঁটে যেতে হয় তাদের বাড়ি। নারী ফুটবল সাফ জয়ী হওয়ায় ঋতুপর্ণা বাড়িতে বিরাজ করছে আনন্দঘন পরিবেশ। মেয়ের এমন অর্জনে খুশিতে আত্মহারা তার মা।
কেউ কথা রাখেনি : ঋতুপর্ণার মা ভূজিপতি চাকমা বলেন, আমার মেয়ের খেলা দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি আমার মেয়ের জন্য সকলের কাছে আর্শিবাদ চাই, যাতে সে আরও ভালো খেলতে পারে। দেশের জন্য সুনাম এলাকার সুনাম আনতে পারে। তিনি বলেন, গতবার যখন আমার মেয়েরা জিতেছিল তখন নতুন ঘর, রাস্তা করে দেওয়ার আশ্বাস দিলেও কিছুই করে দেয়নি। আমার ঝড় বৃষ্টি হলে ভয় লাগে, এই যেন ঘরটা বাতাসে উড়ে গেল। এবার যদি অন্তত আমাদের ঘর ও বাড়িতে আসার রাস্তাটি সরকার করে দেয় তাহলে আমাদের জন্য অনেক উপকার হবে।
ভিডিওকলে ঋতুপর্ণা চাকমা বলেন, এর আগেও প্রশাসন থেকে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে আমাদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তা ও ঘর করে দেওয়া হবে। তবে এই আশ্বাস শুধু আশ্বাসেই রয়ে গেছে। এটা আসলে আজও বাস্তবায়ন হবে কিনা এটা জানি না। তবে আমি নিজের জন্য ব্যক্তিগতভাবে কোনো কিছুই চাই না।