চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের মেধা তালিকায় নাম না থাকলেও আবাসিক হলে থাকছেন ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে অধিকাংশ নেতা চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এবং প্রচারণাও চালাচ্ছেন। মেধা তালিকায় না থাকার পরেও কোন বিবেচনায় রাজনৈতিক নেতারা হলে থাকছেন তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো করেই ‘বিশেষ বিবেচনায়’ আবাসিক হলে আসন পেয়েছেন তারাও।
সোহরাওয়ার্দী হলের আসন বন্টনে মেধাতালিকায় না থাকার পরও বিশেষ বিবেচনায় হলে থাকছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির চবি শাখার নেতা আবরার ফারাবি। তিনি সোহরাওয়ার্দী হল শাখার সভাপতি। হল সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচনে লড়ছেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফারাবি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সোহরাওয়ার্দী হলে উঠেন। তিনি তার পরিচিত একজন সিনিয়র ভাইয়ের আসনে থাকতে শুরু করেন। কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ে নয় বরং একজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হিসেবে প্রভোস্ট থেকে অনুমতি নিয়ে হলে থাকছেন বলে জানান। ফারাবি বলেন, প্রতিটি হলে প্রভোস্টের তত্ত্বাবধানে কিছু সিট থাকে। আবেদনের ভিত্তিতে সিট না পাওয়ায় আমি হল প্রভোস্ট বরাবর সিটের জন্য আবেদন করি। দীর্ঘদিন ধরে হলে আমি শিক্ষার্থীবান্ধব কাজ করে আসছি। তাই হল প্রভোস্ট আমাকে ওনার সংরক্ষিত সিট থেকে একটি সিট প্রদান করেন। তিনি আরও বলেন, ইতিপূর্বে উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন স্যারের সুপারিশ এবং প্রভোস্টের বিশেষ সুপারিশে আরও দুইজন দরিদ্র শিক্ষার্থী সিট পেয়েছেন। আমি অবৈধভাবে কোনো শিক্ষার্থীর সিট দখল করে থাকছি না। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমার বিষয়টি বুঝতে পারবেন।
মেধা তালিকায় না থাকার পরও বিশেষ বিবেচনায় সোহরাওয়ার্দী হলে থাকছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল চবি শাখার নেতা জমাদিউল আওয়াল সুজাত। তিনিও চাকসু নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দী হল সংসদে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুজাত সোহরাওয়ার্দী হলে অন্য একজন শিক্ষার্থীর সিটে থাকছেন। সেই শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতা, দুষ্কৃতি ও নাশকতার অভিযোগ ছিল। এদিকে সুজাত নিজেও পূর্বে ছাত্রলীগের সিএফসি গ্রুপের রাজনীতি করতেন বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে সুজাত বলেন, আমি একটি সিটে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে থাকছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলে মেধা তালিকায় আসন বরাদ্দ পাননি চাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী মো. ওজায়ের হোসেন। তিনি আমানত হলের ৪১৬ নম্বর রুমে থাকছেন। একই হলের ২২০ নম্বর রুম থাকছেন ছাত্রদল মনোনীত প্যানেলের পাঠাগার ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী মো. জাবেদ। জানতে চাইলে জাবেদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) ড. কামাল উদ্দিনের অনুমতি নিয়ে তিনি আমানত হলে ডাবলিং করছেন। যে সিনিয়রের সাথে ডাবলার ছিলেন তিনি হল থেকে চলে যাওয়ায় এখন একা থাকছেন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলে থাকছেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) এর কেন্দ্রীয় যুগ্ম–আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান। তিনি চাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সোহরাওয়ার্দী হলের আসন বরাদ্দে তিনি মেধা তালিকায় আসন পাননি। হলে আসন বরাদ্দের সময় গণ–অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের বিশেষ বিবেচনায় রাখতে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ছিল। তখন আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থী মশিউর রহমান থাকার উদ্দেশ্য বাগছাস নেতা মাহফুজুর রহমানের নামে আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসময় মশিউর রহমান গুরুতর অসুস্থ থাকায় নিজের নামে আসন বরাদ্দ নিয়েছেন বলে জানান বাগছাস নেতা মাহফুজ। তিনি জানান, আমার নামে আসন বরাদ্দ দেওয়া হলেও আমি কখনোই হলে ছিলাম না। মশিউর এই আসনে থাকতো। সম্প্রতি চাকসু নির্বাচনের প্রচারণার কাজে আমি হলের এই আসনে থাকছি। নির্বাচন কেন্দ্রিক কাজ শেষ হয়ে গেলে আমি আবার শহরে ফিরে যাব।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, কোনো শিক্ষার্থীকে রাজনৈতিক বিবেচনায় হলে আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। মেধা তালিকায় না থাকলেও বিশেষ বিবেচনায় আবাসিক হলে আসন পেয়েছেন তারা। তবে আবাসিক হলগুলোতে তদারকি নেই প্রশাসনের। অধিকাংশ হলের প্রভোস্ট নিয়মিত হল পরিদর্শনে আসলেও হাউজ টিউটরদের কার্যক্রম খুবই কম চোখে পড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষ বিবেচনার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর একাডেমিক ফলাফলের পাশাপাশি বাড়ির দূরত্ব ও আর্থিক অস্বচ্ছলতার বিষয়টিও দেখতে হবে।
এদিকে হলে আবেদন করেও আসন বরাদ্দ না পাওয়া শিক্ষার্থী মো. মাহমুদ বলেন, আমার পরিবারের অবস্থা ভালো না। পরিবার থেকে আমার থাকা খাওয়া খরচ দিতে বেগ পোহাতে হচ্ছে। আমি সোহরাওয়ার্দী হলে আসনের জন্য আবেদন করলাম। কিন্তু হল প্রশাসন আমাকে আসন দিল না। অথচ ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা কীভাবে বিশেষ বিবেচনায় হলে আসন পায়? এটা তো হল প্রশাসন ও ছাত্রসংগঠনের নেতারা আমাদের মত নিরীহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর জুলুম করছে।
রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাদের বিশেষ বিবেচনায় আবাসিক হলে থাকার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চবি শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান। তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লব হয়েছিল একটি বৈষম্যহীন ক্যাম্পাস গড়ার লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্য হচ্ছে। প্রশাসন এককভাবে বিশেষ বিবেচনায় কেবল রাজনৈতিক নেতাদের আবাসিক হলে আসন বরাদ্দ দিবে সেটা কিভাবে ন্যায্য হবে? ন্যায় অন্যায়ের নিদিষ্ট মাপকাঠি আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শিবির সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, যারা হলে আসন পেয়েছে তারা তো প্রশাসন এবং প্রভোস্টের সুপারিশে বিশেষ বিবেচনায় আসন পেয়েছেন। প্রত্যেক হলে বিশেষভাবে ১০টির মতো আসন প্রভোস্টের হাতে বরাদ্দ থাকে। যারা আর্থিক সমস্যার কারণে থাকার কষ্ট হয় তাদের জন্য এই আসনগুলো। এখন প্রভোস্ট বা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে হলে থাকলে তো দোষের কিছু না। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা অবৈধভাবে আসন দখল করে থাকলে সেটা তো অন্যায়। প্রভোস্ট প্রশাসনের নিয়মিত তদারকি থাকলে আশা করি এমন হবে না।
হলের আসন বরাদ্দে প্রভোস্টের তত্বাবধানে নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরক্ষিত থাকে জানিয়ে সোহরাওয়াদী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ফারাবি অবৈধভাবে হলে থাকছে না। আমার সুপারিশে হলে ৩ জনের মতো সিট পেয়েছে। ফারাবি হলের প্রায় সবকিছুতে ভূমিকা রাখে। তাই তাকে আমার সংরক্ষিত সিট থেকে একটি সিট দিয়েছি। বাকি দুইজন শিক্ষার্থীর আর্থিক দিক বিবেচনা করে সিট প্রদান করেছি। আমি নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু করিনি।
অতীশ দীপঙ্কর হলের প্রাধ্যক্ষ এজিএম নিয়াজ উদ্দিন বলেন, কেন্দ্রীয় সিট বরাদ্দ কমিটি থেকেই সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে বিশেষ বিবেচনায় প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে কিছু শিক্ষার্থীকে বিশেষ বিবেচনা সিট দেওয়া হয়। আমার হলেও এরকম কয়েকজনকে সিট দেওয়া হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে সংখ্যাটা বলতে পারছি না।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, বিশেষ বিবেচনায় শিক্ষার্থী হলে আসন পেতে পারে, তবে সেটা দ্বৈত আসন। একক আসন বৈধ নয়।
উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠাকালীন পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা হলেও ৬০ বছরে আবাসন হয়েছে মাত্র ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ হাজার শিক্ষার্থীদর মধ্যে আবাসিক হলে থাকার সুযোগ পান ৭ হাজারের মতো শিক্ষার্থী। বাকি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে কটেজ, ভাড়া বাসা ও শহরে থাকেন।