মেজবাহর শত কোটি টাকার প্রতারণা

সাত বছর ধরে নিজেকে পাল্টেছেন, ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে ১১ মামলায় সাজা, আছে ১১টি মামলায় পরোয়ানা

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

কখনো আস্ত স্ক্র্যাপ জাহাজের অংশীদার বানানো আবার কখনো পরের জমি নিজের বলে নানাজনের কাছে বিক্রি। তাছাড়া নিজের শত কোটি টাকার ব্যবসার পার্টনার করাসহ মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে নানাভাবে প্রতারণা করে ‘শত কোটি টাকা’ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে হাটহাজারীর মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।
গত রোববার নগরীর পাঁচলাইশ এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি হাটহাজারীর কাটিরহাট এলাকার আবু তাহের চৌধুরীর পুত্র। র‌্যাব জানিয়েছে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং পাওনাদারদের ঠকাতে নিজের চেহারাও পাল্টে ফেলেন মেজবাহ। গত সাত বছর ধরে নানাভাবে নিজেকে পাল্টে, একেক সময় একেক এলাকায় অবস্থান করে তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। টাক মাথার মেজবাহ হেয়ার প্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে মাথায় চুল বসিয়ে পরিচিতজনদের কাছেও হয়ে উঠেন এক অচেনা ‘ভদ্রলোক’।
তার বিরুদ্ধে ১১টি প্রতারণা মামলায় বেশ কয়েক বছরের সাজার পাশাপাশি আরও ১১টি মামলার পরোয়ানা আছে। গতকাল সোমবার নগরীর চান্দগাঁও ক্যাম্পে র‌্যাবের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ গ্রেপ্তার মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে একজন দাগী প্রতারক বলে মন্তব্য করেন। বলেন, মেজবাহ বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে অভিনব পন্থায় প্রতারণা করেছেন। মেজবাহর বাবা এক সময়ের ইউপি চেয়ারম্যান। মেজবাহ পারিবারিকভাবে অবস্থাপন্ন। বেশ ধনসম্পদ ছিল তাদের। তারা আট ভাই ও তিন বোন। উচ্চ মাধ্যমিকের পর ১৯৯৮ সালে বাবার কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা নিয়ে জাহাজের স্ক্র্যাপ ব্যবসা শুরু করেন তিনি। পরে পার্টনার নিয়ে ব্যবসা বড় করেন। অনেকের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেন। দিনে দিনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। মাসিকভিত্তিতে লাভের টাকা দেয়ার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে প্রচুর টাকা নেন তিনি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত তার ব্যবসা মোটামুটি ভালোই চলতে থাকে। ২০০৮ সালের পর ক্ষতির মুখে পড়ে ব্যবসা। ধার করা টাকা ফেরত দিতে না পেরে চাপে পড়ে যান। আর তখন থেকেই প্রতারণার পথে পা বাড়ান মেজবাহ। লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, ২০১৫ সালের দিকে সীতাকুণ্ডের কুমিরায় খাজা শিপ ইয়ার্ড নামের একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রির জন্য শত কোটি টাকার একটি পুরোনো জাহাজ আমদানি করা হয়। ওই জাহাজটি নিজে কিনেছেন বলে এবং স্ক্র্যাপ বিক্রি থেকে লাভের অংশীদার করার কথা বলে বিভিন্ন জনের কাছ টাকা নিতে শুরু করেন মেজবাহ। এ সময় কেউ ৫০ লাখ, কেউ ১ কোটি, কেউ দেড় কোটি টাকা তাকে দেন। পরবর্তীতে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে বার্থিংয়ে থাকা এরূপ আরো কয়েকটি জাহাজ দেখিয়ে সেগুলো নিজের বলে দাবি করে মেজবাহ একই কায়দায় অংশীদার বানানোর কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতাতে থাকেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন চলে যাওয়ার পরও সেই জাহাজ যখন কাটা হচ্ছিল না, তখন সবাই তাকে চাপ দেয়া শুরু করেন। এ সময় নতুন আরেক গল্প নিয়ে আসেন তিনি। পাওনাদারদের এবার আরেকটি জাহাজ দেখান। সেই জাহাজে কন্টেনারের মতো কিছু পরিত্যক্ত বঙ ছিল। যেগুলো দেখিয়ে পাওনাদারদের মেজবাহ আশ্বস্ত করেন যে, বিদেশ থেকে জাহাজটি কেনার পর এটিতে প্রচুর সোনা পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো তিনি ৫০০ কোটি দামে দেশের বাইরেই বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তার টাকাটা বড় অঙ্কের হওয়ায় আটকে দিয়েছে। এটা উদ্ধার হলে তিনি সবার টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন।
সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, মেজবাহ ওই জাহাজে পাঁচটি ডায়মন্ড রয়েছে বলে আরও একটি গল্প তৈরি করেন। বলেন, এগুলো প্রতিটির মূল্য ২ হাজার কোটি টাকা। এর জন্য সরকারের বিভিন্ন লোকজনকে ম্যানেজ করতে হচ্ছে। এতদিন যে টাকাগুলো লোকজনের কাছ থেকে নিয়েছিলেন সেগুলো দিয়েই তিনি সরকারের লোকজনকে ম্যানেজ করেছেন। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। জাহাজে থাকা পাঁচটি ডায়মন্ডের একটি তিনি পাবেন। বাকিগুলো দিয়ে সরকারের বিভিন্ন জনকে ম্যানেজ করতে হবে। ডায়মন্ডগুলো বিক্রির টাকা পেতে হলে বিভিন্ন মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভাগ দিতে হবে। বিশ্বাস অর্জনের জন্য বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীর কণ্ঠস্বর নকল করে কথোপকথনের রেকর্ড শোনাতো সে। তার যখন যা মনে হতো তখন সেভাবে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করতো। এমন নানা তথ্য উপাত্ত সে উপস্থাপন করতো যে, যেন হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা তার হাতের মোয়া।
নিজের প্রতারণা যাতে বাইরের কেউ জানতে না পারে এজন্য সে বেশ শানসওকতের সাথে চলাচল করতে মেজবাহ। সাজানো গোছানো অফিসের পাশাপাশি মাসিক বেতনের ভিত্তিতে ২০/২৫ জন মানুষকে নিয়োগ দিয়ে রাখা হয়েছিল। যাদের কাজ ছিল কেউ মেজবাহ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গেলে তাকে যেন বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেয়। এতে বিশ্বাস স্থাপন করে অসংখ্য মানুষ তার কাছ থেকে জাহাজ কেনার পাশাপাশি জায়গা জমি কিনেছে, ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে।
র‌্যাব অধিনায়ক আরও বলেন, ভুক্তভোগীরা তার কাছে পাওনা টাকা চাইতে গেলে সে ভুক্তভোগীদের আগে থেকে রাখা স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ভুয়া দলিল দস্তাবেজ তৈরি করে তাদেরকেই উল্টো মিথ্যে মামলার ভয় ও মামলা দিয়ে নাজেহাল করতো। মিথ্যে মামলার ভয়ে অনেক ভুক্তভোগীই পাওনা টাকার বিষয়ে মুখ খোলার সাহস করতো না। এম এ ইউসুফ আরও বলেন, মেজবাহর ব্যাপারে বেশ কিছুদিন ধরে অভিযোগ পাচ্ছিলাম। শুরুতে আমাদের ধারণা ছিল, তিনি বিদেশে পালিয়ে গেছেন। কারণ দেশে তার অবস্থান কোনোভাবেই শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না। গত সাত বছরে তিনি কয়েকশ মোবাইল সিম ব্যবহার করেছেন। এর একটি সিমও তিনি নিজের কাছে রাখতেন না। কয়েকদিন পরপরই পাল্টে ফেলতেন। চট্টগ্রাম শহরে স্থায়ীভাবে কোথাও বসবাসও করতেন না। ঢাকায়ও তার কোনো বাসা ছিল না। একেকদিন একেক হোটেলে অবস্থান করতেন। চট্টগ্রামে এলে খুব অল্প সময়ের জন্য ভাই-বোনদের বাসায় থাকতেন। সব মিলিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিল। আমাদের কাছে তার যে ছবি ছিল তাতে তার চুল ছিল না।
র‌্যাব জানায়, গত সাত বছর ধরে মাঝেমধ্যে অ্যাপস ব্যবহার করে বিভিন্নজনকে কল দিতেন মেজবাহ। কিন্তু সবগুলো নম্বরই দেশের বাইরের নম্বরের মতো দেখা যেত। তারপরও র‌্যাব তাকে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যায়। হেডকোয়ার্টারের গোয়েন্দা বিভাগেরও সাহায্য নেয়া হয়। অবশেষে রোববার হঠাৎ খবর পাওয়া যায়, নগরীর পাঁচলাইশের হামজারবাগ এলাকায় বোনের বাসায় এসে উঠেছেন মেজবাহ। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচলাইশের হামজারবাগের আজাদ কমিউনিটি সেন্টারের ওপরের একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানের শুরুতে মেজবাহর বোন প্রায় ১ ঘণ্টা বিভিন্ন অজুহাতে ঝামেলা তৈরির চেষ্টা করেন বলেও জানান র‌্যাবের কর্মকর্তারা। গ্রেপ্তারকৃত মেজবাহকে গতকাল আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাকে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন বলেও সূত্র জানিয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়ির তিন ফুটবলার ও সহকারী কোচের জন্য চার লাখ টাকা পুরস্কার
পরবর্তী নিবন্ধঝুঁকিপূর্ণদের তালিকা হচ্ছে