গুহাবাসী মানুষ একমাত্র শ্রমের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছিল উন্নত সভ্যতার। জন্ম মানুষের অধীন না হলেও কর্ম নিজের অধীন। এই শ্রমের ধারা পরিবর্তিত হলেও শ্রমিকদের অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। সামন্ত যুগে যাদের অবস্থা ছিল ক্রীতদাসের মতো– শিল্প বিপ্লবের পরে উৎপাদন ও ভোগের পরিবর্তন হলেও শ্রমজীবী সাধারণ শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি হয়নি। ফলশ্রুতিতে আট ঘণ্টা শ্রম সহ নানা শোষণের বিরুদ্ধে ১৮৮৬ সালের পহেলা মে হে মার্কেট অ্যাফেয়ার নামে এক সহিংস বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হলো এ দিবস এবং স্বীকৃতি পেল মে দিবস হিসেবে।
মে দিবস পালিত হয় ‘আট ঘণ্টা হোক শ্রম ঘণ্টা’ এই দাবিতে। কিন্তু প্রশ্ন এসে যায়– কেটে গেছে বহু বছর, অনেক প্রহর– কিন্তু নারীর আটঘণ্টা শ্রম – এ বিষয়ের কি কোনো সমাধান হয়েছে এখনো! বিশেষত অদৃশ্য শ্রমের। পারিশ্রমিক বা বিনা পারিশ্রমিকে নারীরা শ্রম দেয়– শারীরিক ও মানসিক শ্রমের পরিপ্রেক্ষিতে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনো নারীরা ‘আধঘণ্টা শ্রমের বাইরে বিনোদন, বিশ্রাম – এই বিলাসিতা উপভোগ করতে পারে নি।’
কারখানার নারী শ্রমিকের শোষণের ওপর মালিকের মুনাফা– কিন্তু কর্মপরিবেশ বা মজুরি কতোটা তাদের অনুকূলে! তেমনি কৃষিতে, খনিতে, পর্যটন শিল্পে বা চা বাগানে বা ইটভাঙায়সহ বিভিন্ন খাতে নানাভাবে শোষিত।
আন্তর্জাতিক কর্পোরেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শক্তিশালী ব্যক্তিরা বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য এবং নারীর বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বৈষম্যের সুযোগ নিয়েছে–যাতে নারীরা তাদের কর্তৃক সরবরাহ শৃঙ্খলে সস্তা শ্রমের উৎস হয়ে ওঠে। মানব কল্যাণের জন্য অপরিহার্য যত্নশীল শ্রমপ্রদানের উৎস হচ্ছে নারীশ্রম– অথচ এই দিকটা উপেক্ষিত, যে কারণে তুরস্কের একজন নারীবাদী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ইপেক ইলক্কারাকান বেগুনি অর্থনীতি তথা যত্নশীল শ্রমের স্থায়িত্বকে কেন্দ্র করে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আহ্বান জানিয়েছেন।
২০১৮ সালে স্পেনের নারীরা লিঙ্গ সমতা এবং কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসানের দাবি যেমন গৃহকর্ম, কারখানার নারী শ্রমিক, স্বাস্থ্য শ্রমিকদের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, যৌন হয়রানি, গর্ভাবস্থার কারণে বৈষম্য নিরসনের দাবিতে ধর্মঘট করেছিলেন। এভাবে নারী শ্রমিকেরা বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় নেমেছে – যদিও এরপরেও তাদের ক্ষেত্রে বৈষম্য কমেনি। মূখ্যত নারীরা নানা কারণে বৈষম্যের শিকার– যা ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধা দেয় – এ যেন স্টোরিও টাইপ এবং কাচের ছাদ।
বাংলাদেশে নারী শ্রমিকের হার কৃষিখাতে সবচেয়ে বেশি – এরপরে আছে শিল্পখাত এবং গৃহস্থালি শ্রম তথা অদৃশ্য খাতে সবচেয়ে বেশি।
এ দিবসের পরিপ্রেক্ষিতে নারী শ্রমিকেরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয় – তা হল লিঙ্গভিত্তিক বেতন বৈষম্য, গৃহস্থালি শ্রম– কর্মজীবনে ভারসাম্যের অভাব– প্রতিকূল কর্মপরিবেশ ইত্যাদি। এর অন্যতম কারণ মেয়েদের শিক্ষা অর্জনের পথে এখনো অনেক বাঁধা – বিশেষত ক্যারিয়ার গঠনের জন্য কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত না করা, বাল্য বিবাহ, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব সহ আরও অনেক প্রতিকূলতা যা নারী কর্তৃক প্রদেয় শ্রমের মূল্যায়ন হচ্ছে না।
মে দিবসের আলোকে বলতে হয়– নারীর শ্রমের যথাযথ মূল্যায়নে প্রথমত যে সব নারী তাদের শ্রমে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছেন– তাদের জন্য সমতার ভিত্তিতে একটি সুন্দর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা।
এছাড়া সার্বিক ভাবে উচ্চ শিক্ষা অর্জনে উৎসাহিত করা, কর্মক্ষেত্রে সমতা আনয়ন, নারীর অধিকারের প্রতি মর্যাদা, বিয়ে ও সন্তান প্রসবের পরে তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা, নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টি, নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ইত্যাদি।
মে দিবসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করে আমাদের প্রত্যাশা – দেশ ও জাতির কল্যাণে সব শ্রমিকেরা যেন তাদের শ্রমের যথাযথ মর্যাদা পান। তাদের যেন অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নামতে না হয়। বিশ্বের সব শ্রমিকের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ।