চারপাশে মৃত্যু ঘুরে বেড়াচ্ছে। শহরের আকাশে যেন অদৃশ্য এক কালো পর্দা, যার নিচে আমরা হেঁটে চলেছি প্রতিদিন। সকালবেলা খবরের কাগজ হাতে নিলেই মনে হয় রক্তমাখা কোনো পাণ্ডুলিপি উল্টে যাচ্ছি–বিমান দুর্ঘটনায় স্বপ্ন ভাঙা তরচণ শিক্ষার্থীর গল্প, রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণ হারানো মানুষের সংবাদ, রাস্তায় প্রকাশ্যে পাথর ছুড়ে হত্যা, নারীর দেহে নিষ্ঠুরতার দাগ, কিংবা রাতের অন্ধকারে ছিনতাইকারীর হাতে জীবন হারানোর ঘটনা। মৃত্যু যেন এখন আর হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো দুঃসংবাদ নয়, যেন দেশের প্রতিটি মোড়ে আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে।
আমরা কি কল্পনাও করতে পেরেছিলাম–কোনো সমাজ এতটাই অসাড় হয়ে যেতে পারে? যখন খবর হয়, এক তরচণী ধর্ষিত হয়ে মারা গেছে, অথবা এক স্কুলছাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় লাশ হয়ে ফিরেছে, তখন আমাদের বুক কেঁপে ওঠে না, শুধু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অথচ এই অভ্যস্ততাই সবচেয়ে ভয়ংকর।
রাজনীতির মাঠও রক্তে ভিজে থাকে প্রায়ই। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য বলছে, গত দুই বছরে রাজনৈতিক সংঘাতে দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। কারও বাবা, কারও সন্তান, কারও স্বামী; কিন্তু সংখ্যার আড়ালে থেকে যায় একেকটি নিঃশেষ হওয়া পরিবার।
আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? কেমন এক সমাজে পরিণত হয়েছি আমরা? কেন আমাদের হাতে পাথর ওঠে, কেন আমরা রাস্তায় একজনকে পিটিয়ে মারি, কেন আমরা ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ি অন্যের জীবন কেড়ে নিতে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে বারবার বোঝা যায়, ভয় আর ক্ষোভে ভরা, অবিশ্বাসে ভরা এক অস্থির সময়ের ভেতর আমরা আটকে আছি।
এখন শহরে কোনো মানুষ নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে না। মা সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে বুকের ভেতর সারা দিন অদৃশ্য শঙ্কার বোঝা বহন করেন। বাবা ফোন হাতে বারবার খোঁজ নেন–ঠিকমতো ফিরছে তো? কর্মজীবী নারীর জন্য পথ যেন এক অদৃশ্য গোলকধাঁধা, যেখানে প্রতিটি মোড়ে লুকিয়ে আছে আতঙ্ক। এ যেন এক নতুন স্বাভাবিকতা। আমরা এখন আর সুখের খোঁজ করি না, খুঁজি নিরাপত্তা। প্রতিদিন ভাবি–আজ যদি কোনোভাবে বেঁচে ফিরতে পারি, তবেই জয়। মানুষে মানুষে যে আস্থা একসময় সমাজের ভিত শক্ত করেছিল, তা এখন ভেঙে গেছে। আমরা আর কারও প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারি না। হঠাৎ পাশে কেউ সাহায্য করতে চাইলে মনে প্রশ্ন জাগে–সে কি সত্যিই সাহায্য করতে এসেছে, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য? এই সন্দেহ আমাদের ভেতর থেকে খেয়ে ফেলছে। যে আন্তরিকতা, মানবিকতা, সহমর্মিতা একসময় আমাদের শক্তি ছিল–সেগুলো যেন ক্রমে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সম্পর্কের উষ্ণতা শুকিয়ে গেছে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বও যেন কেবল প্রয়োজনমাফিক টিকে আছে।
এই সমাজে মানুষ প্রতিদিন নিজের বেঁচে থাকার জন্য এমনভাবে লড়ছে যে ধীরে ধীরে তার মন ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। এই ক্লান্তি থেকে জন্ম নিচ্ছে অসাড়তা। ফলশ্রচতিতে আমরা অন্যের দুঃখের কাছে উদাসীন হয়ে যাচ্ছি। অন্যের কান্না আর আমাদের কান্না ছুঁতে পারছে না। যেন কষ্ট দেখে চোখের জল শুকিয়ে গেছে।
তবুও আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এই অন্ধকারের মাঝেও কিছু আলো থেকে যায়। দুর্ঘটনার খবরে ছুটে যাওয়া রক্তদাতারা, পথশিশুর মুখে খাবার তুলে দেওয়া অপরিচিত মানুষ, অথবা কারও জন্য অচেনা পথের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসা কয়েকটি হাত–এগুলো প্রমাণ করে, মানুষের ভেতরের মানবিকতা পুরোপুরি নিভে যায়নি। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, মানুষের ভেতরে মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দরকার এমন পাঠ, যা কেবল পরীক্ষায় পাশ করার জন্য নয়, মানুষ হওয়ার জন্য।
তবুও, বর্তমান বাস্তবতা হলো–বাংলাদেশের প্রতিটি রাস্তায় এখন আতঙ্কের ছায়া। রাতের শহর যেন নিঃশব্দে বলে যায়, “সাবধানে চল, জানি না কে ফিরে আসবে।” মৃত্যুর এই মিছিলের কোনো শেষ নেই। তবুও আমরা বেঁচে আছি। দিন শেষে ঘরে ফিরে আমরা শ্বাস নিই, বেঁচে থাকার স্বস্তি নেই। ভোর হলে আবার বের হয়ে পড়ি অদৃশ্য এই যুদ্ধের ময়দানে। কারণ আমাদের ভেতরে এখনো কোথাও একটা ছোট্ট আলো জ্বলে–একদিন হয়তো এই মৃত্যু আর শোকের মিছিল থেমে যাবে, একদিন এই ভয়ের শহর আবার হবে নিরাপত্তার, ভালোবাসার, মানুষের শহর। সেই স্বপ্ন নিয়েই আমরা হাঁটছি–ক্ষতবিক্ষত হয়েও, ভেঙে পড়েও, তবুও জীবনের প্রতি অদ্ভুত এক অঙ্গীকার নিয়ে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।












