মৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর জাল করে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সার কারখানা থেকে উত্তোলন করা হয়েছে কোটি কোটি টাকার সার। সরকারি তিনটি সার কারখানা থেকে গত ১০ বছর ধরে উত্তোলন করা এসব সারের বড় একটি অংশ পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে পাচার করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ফলে সরকার প্রতি বস্তা সারে তিনশ’ টাকার বেশি ভর্তুকি দিলেও দেশের কৃষকরা এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে জানা গেছে। সংঘবদ্ধ একটি চক্র সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে এসব সার পাচার করলেও লাইসেন্সের মূল মালিকের ছেলে এসব কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, আমি প্লাস্টিক ক্রোকারিজের ব্যবসা করি। সারের ডিলারশিপের কিছুই জানি না। তবে বিষয়টি নিয়ে জানাজানি হলে বিসিআইসি এবং সংশ্লিষ্ট সার কারখানাগুলোতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, সার দেশের কৃষি খাতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। কৃষি খাতে ভর্তুকির বড় একটি অংশ এই সারে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক বাজার দরে কাফকো থেকে কেনা সার সরকার সাশ্রয়ী মূল্যে কৃষকদের মাঝে বিক্রি করে। দেশিয় কারখানাগুলোতে উৎপাদিত সার চড়া দামে বিদেশে বিক্রির সুযোগ থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে বহু কম দামে তা দেশের কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়। প্রতি বস্তা সারে সরকার কমপক্ষে তিনশ’ টাকা ভর্তুকি দেয়। বিসিআইসি দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সার খাত নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের অনুমোদিত এবং কৃষি অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ৫১৭ জন ডিলার কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করেন। কৃষি এলাকা রয়েছে এমন উপজেলাগুলোতে গড়ে ৮ থেকে ১০ জনের মতো ডিলার থাকেন। প্রতিটা ইউনিয়নের চাহিদা বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, থানা নির্বাহী অফিসার ও জেলার কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক সারের চাহিদাপত্র তৈরি এবং সার বরাদ্দের বিষয়টি দেখভাল করেন। সংশ্লিষ্ট ডিলার উক্ত বরাদ্দপত্র কারখানাগুলোতে জমা দিয়ে সার উত্তোলন করে তা ওই ইউনিয়নের কৃষকদের কাছে বিক্রি করেন।
সার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রচলিত এই নিয়মের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বহু ডিলারই কোটি কোটি টাকার সার উত্তোলন করে তা পাচার করে দেন। বিশেষ করে মিয়ানমারে বাংলাদেশী সারের প্রচুর চাহিদা। সেখানে আন্তর্জাতিক বাজারদরে সার বিক্রি হয়। বাংলাদেশের প্রতি বস্তা ৭০০ টাকার সার নদী পথে মিয়ানমার পৌঁছে দিতে পারলে ১২শ’ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। প্রতি বস্তা সারে নগদ ৫শ’ টাকারও বেশি লাভ হওয়ায় বহু ডিলার নিজের এলাকার কৃষকদের সার না দিয়ে তা মিয়ানমারে পাচার করে দেন। বহু বছর ধরে চলছে সার পাচারের এই কার্যক্রম। নগরীর মাঝিরঘাট কেন্দ্রিক একটি চক্র এই কার্যক্রমে জড়িত বলে জানা গেছে। অবশ্য, একসময় রাতে দিনে সার পাচার হলেও এখন তা অনেকাটা কমে এসেছে বলে সূত্র মন্তব্য করেছে। কিন্তু সার সেক্টরের আগের বহু গোঁজামিলকে পেছনে ফেলে এবার মৃত ব্যক্তির নামে সার উত্তোলনের ঘটনা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
পটিয়া ১৪ নং ভাটিখাইন ইউনিয়নের ভাটিখাইন গ্রামের মৃত কালা মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ আবদুল ছবুর সওদাগর বিসিআইসির অনুমোদিত এম এ সবুর এন্ড ব্রাদার্স নামে একটি লাইসেন্স নেন। তার স্বাক্ষরেই এই ডিলারশিপ পরিচালিত হতো। তিনি ফটিকছড়ির বক্তপুর ইউনিয়নের জন্য বিসিআইসির ডিলার হিসেবে অনুমোদিত। প্রতি মাসে এই লাইসেন্সের বিপরীতে সার উত্তোলন এবং তা কৃষকদের মাঝে বিক্রি করতেন।
২০১১ সালে আবদুল ছবুর সওদাগর স্ত্রী মরিয়ম বেগম, ছেলে মোহাম্মদ ইউনুচ ও ইছহাক মিয়া এবং মেয়ে নুরজাহান বেগম, নুর নাহার বেগম, নুর আয়েশা বেগমকে রেখে মারা যান। তিনি মারা গেলেও তার স্বাক্ষর জাল করে তার লাইসেন্সের বিপরীতে গত ১০ বছর ধরে প্রতি মাসেই সার উত্তোলন করা হয়েছে। চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল), ডিএপি সার কারখানা এবং টিএসপি কমপ্লেক্স থেকে এসব সার উত্তোলন করা হয়। এসব সারের বড় একটি অংশ পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনটি কারখানা থেকে প্রতি মাসে উত্তোলন করা লাখ লাখ টাকার সার পাচারের সাথে সংঘবদ্ধ একটি চক্র জড়িত বলে সূত্র জানিয়েছে।
আবদুল ছবুর সওদাগরের বড় ছেলে মোহাম্মদ ইউনুছ মিয়া ইতোমধ্যে মারা গেছেন। ছোট ছেলে মোহাম্মদ ইছহাক মিয়া মাসুদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার বাবা আবদুল ছবুর ১০ বছর আগে মারা গেছেন। লাইসেন্সের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, কিছুই জানেন না। পটিয়া সদরে প্যারাগন ক্রোকারিজের মালিক মোহাম্মদ ইছহাক মিয়া জানান, তিনি প্লাস্টিক ক্রোকারিজের ব্যবসা করেন। সারের লাইসেন্সের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। অথচ আবদুল ছবুরের নামে গত সপ্তাহেও সার উত্তোলন করা হয়েছে। ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে সার উত্তোলনের জন্য প্রেরিত তালিকাতে মেসার্স এম এ ছবুর এন্ড ব্রাদার্স নামে ডিলারের নাম রয়েছে। আবদুল ছবুরের ইংরেজী স্বাক্ষর করা পত্র নিয়ে প্রতি মাসেই সার উত্তোলন করা হত। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি আবদুল ছবুরের প্রতিনিধি হিসেবে সার উত্তোলন করতেন। ওই প্রতিনিধির নমুনা স্বাক্ষর আবদুল ছবুরের নামেই সত্যায়িত করা হত। গত ১০ বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কারখানাগুলো থেকে এভাবে সার উত্তোলন করা হয়েছে।
এছাড়া ভাটিখাইন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম স্বাক্ষরিত আব্দুল ছবুরের মৃত্যুর সত্যতা সংশ্লিষ্ট একটি ওয়ারিশান সনদও দৈনিক আজাদীর হস্তগত হয়েছে। গতকাল এ ব্যাপারে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভাটিখাইনের কালা মিয়ার ছেলে আব্দুল ছবুর বহু আগেই মারা গেছেন।
এদিকে স্বাক্ষর জাল করে সার উত্তোলনের ব্যাপারে ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইদুল আরেফিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ধরনের কোনো ঘটনা আমার জানা নেই। আমাকে কেউ বলেনি। প্রতিবেদকের কাছ থেকে তিনি এই অভিযোগ প্রথম শুনছেন উল্লেখ করে তা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন এবং বিষয়টি কৃষি অফিসার দেখেন বলে জানান। ইউএনও বলেন, মৃত ব্যক্তি তো ডিলার থাকার কথা নয়। উনার ওয়ারিশদের কেউ তো লাইসেন্সের মালিক হতে পারতেন।
বিষয়টি জানতে ফটিকছড়ি উপজেলার কৃষি অফিসার লিটন দেবনাথের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি আগামীকাল রোববার যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, অফিসে গিয়ে কাগজপত্র দেখে বলতে পারব। তবে এই ধরনের কোনো বিষয় তার জানা নেই বলে তিনি দাবি করেন।
এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, এটি তো হতে পারে না। মৃত ব্যক্তির নামে সার উত্তোলন করা অসম্ভব। তিনি বিষয়টি নিয়ে ফটিকছড়ি কৃষি অফিসারের সাথে কথা বলবেন বলে জানান।
বিসিআইসি এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা যায়, মৃত আবদুল ছবুরের স্বাক্ষর জাল করে প্রতি মাসেই সার উত্তোলন করা হয়েছে। ফটিকছড়ির মেসার্স হারুন স্টোরের মালিক মোহাম্মদ হারুন এই সার উত্তোলনের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে গতকাল মোহাম্মদ হারুনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি এত কিছু জানি না। আবু সাদাত মোহাম্মদ শামীম ও তার ম্যানেজার আজগর আমাদেরকে সার উত্তোলন করে দেন। আমরা তা বিক্রি করি। শামীম কিসের ভিত্তিতে সার উত্তোলন করেন তা তিনি জানেন বলে দাবি করেন।
এ ব্যাপারে সিইউএফএল কারখানার ডিজিএম মোহাম্মদ আবদুল হামিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা বরাদ্দপত্রের বিপরীতে সার সরবরাহ করি। এখন বরাদ্দপত্র কিভাবে তৈরি হলো তা-তো আমরা দেখি না। এটি আমাদের দায়িত্বেও পড়ে না। তবে মৃত ব্যক্তির নামে সার উত্তোলনের কথা তিনি আগে কোনো দিন শুনেননি বলে জানান। বিসিআইসির একাধিক কর্মকর্তা এবং কয়েকজন ডিলার দৈনিক আজাদীকে বলেন, একজন ডিলারকে প্রতি বছর গড়ে ৭০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত সার সরবরাহ দেয়া হয়। পাঁচশ’ টনের মতো সার পান একেকজন ডিলার। বাংলাদেশে ৭০ লাখ টাকা দামের সারের মূল্য মিয়ানমারে প্রায় দুই কোটি টাকা বলে সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।