আমাদের চারপাশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের মানুষ কি দিন দিন চিরায়ত কৃষ্টি, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা, পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ ও অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? এর কারণ দেশের বিভিন্ন জনপদে একের পর এক যেসব অনৈতিক ও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে চলেছে, সেসব ঘটনা কোনোভাবেই আমাদের দেশের মানুষের আচার-আচরণের সঙ্গে মেলে না। আমাদের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, আদব-কায়দা ও মায়া-মমতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করা। পরিচিত হোক আর অপরিচিত হোক, একের দুঃখে অপরের দুঃখিত হওয়া, সহমর্মীতা প্রকাশ করা, পাশে দাঁড়িয়ে সান্তনা দেয়া। তরুণদের কেউ বিপথগামী হলে, তাকে বারণ করা। সমাজে অসঙ্গতি দেখা দিলে, সামাজিকভাবে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া, এমনকি পারিবারিক কলহ মিটাতেও এগিয়ে আসা। বাংলাদেশের মানুষের বৈশিষ্ট্য তো এই যে, তারা সমাজ ও পরিবারে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সবসময়ই সচেতন। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় দিন দিন বেড়েই চলছে; যার লাগাম না টানলে জাতিকে চরম মাশুল দিতে হতে পারে। এখনই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে জাতি হিসেবে আমরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাব। অনেককে বলতে শুনি, আমরা সম্ভবত আমাদের নৈতিক বিপর্যয়ের চরম সীমায় অবস্থান করছি; নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে দিন দিন সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। তুচ্ছ ঘটনা বা সামান্য স্বার্থের জন্য কত মানুষকে জীবন পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। নৈতিক বা অনৈতিক যেভাবেই হোক, আমরা নিজের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া। যে দেশে দিনের আলোয় জনসম্মুক্ষে একজন স্ত্রীর সামনে তার স্বামীকে হত্যা করা হয়, একটা তরুণীকে বিপর্যস্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে তাকে আত্মহননের পথ বাছাই করতে হয়; সে দেশের মানুষের নৈতিকতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা আমরা অনেক আগেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের মা-বোনরা; এমনকি শিশুরা পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এসব কিছুই আমাদের নৈতিকতা বিপর্যয়ের চরম অবক্ষয়ের ফলাফল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নৈতিকতা হলো এমন মানবিক গুণ যা অন্তরে ধারণ করলে সদাচার, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, নির্মলতা ও সৎকাজে আগ্রহ উদ্যম বিরাজ করে। অনাচার, নারীলিপ্সা, অশালীন ও অপকর্মে লিপ্ত হতে বাধা আসে। যার মধ্যে নৈতিকতা নেই সে মুক্ত বিহঙ্গ। সাময়িক আনন্দ ও তৃপ্তি পাওয়ার জন্য সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কিন্তু যার মধ্যে নৈতিকতা আছে, সে ইচ্ছা থাকলেও সবকিছু করতে পারে না বা করে না। বর্তমানে সমাজে নৈতিকতার চরম অবক্ষয় ঘটছে। পত্রিকার পাতার চোখ বোলালে বোঝা যায় আমাদের দেশে নীতি-নৈতিকতার অভাব কত প্রকট!
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়ে যুবসমাজের চিন্তা, চেতনা ও মননে বিদেশি সংস্কৃতি বিরাজ করছে। তারা অন্ধভাবে তাদের অনুসরণ ও অনুকরণের চেষ্টা করছে। অঞ্চল, সামাজিকতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় কারণে বিদেশিদের সঙ্গে আমাদের যে ভিন্নতা থাকার কথা, তা আজ আমাদের মধ্যে নেই। এমন অনেক বিষয় আছে যা তাদের দৃষ্টিতে কিংবা তাদের দেশে স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশে তা দৃষ্টিকটু, এমনকি অপরাধ। আমাদের অনেকে তাদের এই জীবনাচারকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছে। এমন কাজে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করছে। এভাবে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে। তাছাড়া বিদেশি সিনেমায় যে অশালীন ও অশ্লীল দৃশ্য দেখানো হয়, সেটা যুবসমাজের সম্ভ্রম বিনষ্ট করছে। নির্লজ্জতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মনের মধ্যে পশুত্বকে জাগিয়ে তুলছে। ফলশ্রুতিতে সুযোগ পেলে ধর্ষণের মতো অপকর্মে লিপ্ত হতে কেউ দ্বিধাবোধ করছে না।
আমরা দুঃখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছি, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেও মানুষের অপরাধপ্রবণতা কমেনি, বরং বেড়ে চলেছে উদ্বেগজনকভাবে। একশ্রেণির মানুষ প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ- কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি নয়, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের প্রসার ও সচেতনতার মাধ্যমে এই পতন আমাদের রুখতে হবে।