মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১৯০৪–১৯৮৭)। লেখক, শিক্ষাবিদ, ও সম্পাদক। লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি খ্যাতিমান। মনসুরউদ্দীন মনে প্রাণে ছিলেন বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি, বিশেষত লোকসংস্কৃতির একজন একনিষ্ঠ অনুরাগী। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর থানার মুরারিপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। পাবনায় স্কুল ও কলেজ জীবনের পাঠ চুকিয়ে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন তিনি। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার বিভাগ থেকে বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রবাসী পত্রিকা তাঁকে লালনগীতির সঙ্গে পরিচিত করায়। গ্রামে–গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা এসব লোকসংগীত মনসুরউদ্দীনকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে। পরবর্তীকালে রাজশাহী কলেজ–এ বিএ পড়ার সময় কলেজে অনুষ্ঠিত এক সাহিত্যসভায় তিনি ‘বাংলাদেশের পল্লীগান’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। তাঁর প্রবন্ধে মুগ্ধ হয়ে কলেজের অধ্যক্ষ কুমুদিনীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ফোকলোর চর্চায় উৎসাহিত করেন। মনসুরউদ্দীন মনেপ্রাণে ছিলেন বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি, বিশেষত লোকসংস্কৃতির একজন একনিষ্ঠ অনুরাগী। ছাত্রজীবনে অধ্যয়নের ও পরবর্তীকালে অধ্যাপনার অবসরে তিনি পদ্মার চরাঞ্চল এবং পাবনা–ফরিদপুর–কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে গান, ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ, গল্প ইত্যাদি লোকসাহিত্যের অনেক উপাদান সংগ্রহ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ফোকলোর চর্চা দেশের সুধীমহলের স্বীকৃতি লাভ করে। কর্মজীবনের শুরু করেন সহকারী স্কুল পরিদর্শক হিসেবে। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (স্কুল শাখা), হাওড়া জেলা স্কুল, চট্টগ্রাম সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ছয় মাসের জন্য তিনি ঢাকায় সরকার পরিচালিত মাহে নও মাসিকপত্রের সম্পাদক ছিলেন। ওই বছরেরই শেষ দিকে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে লন্ডন যান। লন্ডন থেকে ফিরে ওই বছরই তিনি ঢাকা কলেজ–এ বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পূর্বে তিনি বেশ কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের খন্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সামরিক সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠ। সাহিত্যকৃতীর স্বীকৃতি স্বরূপ মনসুরউদ্দীন অর্জন করেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: ‘শিরণী’, ‘ধানের মঞ্জরী’, ‘আগরবাতী’, ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’ (তিন খণ্ডে রচিত), এবং ‘ইরানের কবি’। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।