দেওয়ানী আদালতের অধিকাংশ চর্চিত মামলা হচ্ছে সম্পত্তি বন্টন মামলা। এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে অনেক সময়কাল অতিবাহিত হয়। এমনকি অনেক সময় বংশপরম্পরায়ও এই মামলা চলতে থাকে। কিন্তু মুসলিম উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে মামলা করার প্রয়োজন হতো না। মহান আল্লাহ্-রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে এর বিস্তারিত বর্ণনা করে দিয়েছেন। আমাদের বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আজ থেকে ১৪০০ বছর আগেই বলে গিয়েছেন “উত্তরাধিকার আইন নিজে জানো ও অপরকে শেখাও, সকল জ্ঞানের অর্ধেক হল জ্ঞান।”
অথচ প্রকৃত মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও আমাদের অনেকেরই উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। কিন্তু প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির এই আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। মুসলিম আইনে কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার আলোকে মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে বন্টন করা হয়। এই বন্টন রীতিকে ফারায়েজ বলা হয়।
আজ আমি উক্ত লেখনীতে মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি কিভাবে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন করা হবে তা আলোচনা করব।
কোন মুসলমান ব্যক্তি মারা গেলে তার সম্পত্তি বন্টনের আগে কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন আবশ্যক। যেমন মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি হতে সেখান থেকে আগে তার দাফন কাফনের প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে হবে। তিনি যদি জীবিত থাকাবস্থায় কোন ধার দেনা করে থাকেন তবে তাও রেখে যাওয়া সম্পত্তি হতে পরিশোধ করে দিতে হবে। তার স্ত্রীর যদি দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকলে বা আংশিক অপরিশোধিত থাকলে তা পরিশোধ করে দিতে হবে।
মৃত ব্যক্তি কোন দান বা উইল করে দিয়ে গেলে প্রাপককে তা বুঝিয়ে দিতে হবে।
উপরোক্ত কাজসমূহ সম্পাদনের পরে অবশিষ্ট সম্পত্তি মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে। কিভাবে কি অনুপাতে সম্পত্তি বন্টন করা হবে তা নিম্নে উল্লেখিত প্রাথমিক ৬ জন উত্তরাধিকারী যারা কখনো সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয় না। যথা- ১. পিতা, ২. মাতা, ৩. স্বামী, ৪. স্ত্রী, ৫. পুত্র, ৬. কন্যা।
১. পিতার অংশ : মৃত ব্যক্তির সম্পদের উপর তার পিতা ৩ প্রকারের সম্পদ পাবেন, যথা-
ক) যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র, পুত্রের কিংবা আরও নিচে পুত্রের পুত্রের পুত্র যত নিচেই হোক না কেন যদি থাকে, তবে মৃত ব্যক্তির পিতা পাবেন সম্পদের ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬)।
খ) যদি মৃত ব্যক্তির কোন পুত্র কিংবা নিম্নগামী পুত্র না থাকে কেবল কন্যা থাকে, তবে ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬) পাবেন এবং কন্যাদের ও অন্যান্যদের দেওয়ার পর যে সম্পত্তি থাকে তাও পাবেন।
গ) যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান না থাকে তবে বাদবাকি অংশীদারদের দেয়ার পর সকল সম্পত্তি পিতা পাবেন। মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান না থাকলে যদি পিতাও না থাকে তবে জীবিত ভাই সম্পত্তি পাবে, ভাই না থাকলে ভাইয়ের সন্তান পাবে।
২) মাতার অংশ : মৃত ব্যক্তির মাতা তিনভাবে সম্পদ পাবেন। যথা-
ক) যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যতই নিম্নের হোক, থাকলে অথবা যদি পূর্ণ, বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাই বা বোন থাকে তবে মাতা ১/৬ অংশ পাবেন।
খ) যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকে এবং একজনের বেশি ভাই বা বোন না থাকে তবে মাতা তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩ অংশ) পাবেন।
গ) যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকে অথবা কমপক্ষে দুইজন ভাই বোন না থাকে এবং যদি মৃত ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী অংশ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩) মাতা পাবেন।
৩) স্বামী : স্বামী দুই ভাবে স্ত্রীর সম্পত্তি পাবে যথা-
ক) যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান সন্তনি থাকে তবে স্বামী পাবে এক চতুর্থাংশ (১/৪) অংশ।
খ) যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান সন্তনি না থাকে তবে স্বামী পাবে (১/২) অর্ধেক সম্পত্তি।
৪) স্ত্রী : স্ত্রী মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি ২ (দুই) ভাবে পাবে যথা-
ক) যদি মৃত ব্যক্তির এবং তার স্ত্রীর সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকে তবে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ (১/৮) পাবেন।
খ) যদি মৃত ব্যক্তি এবং তার স্ত্রীর সংসারে কোন সন্তান না থাকে তাহলে স্ত্রী মোট সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ (১/৪) পাবেন।
৫) পুত্র : পুত্র সকল ক্ষেত্রেই মৃত ব্যক্তির সম্পদ পেয়ে থাকে। এছাড়া মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি সকলের অংশ এক ভাগের পর অবশিষ্ট সকল অংশ পুত্র কন্যারা পাবে। এক্ষেত্রে পুত্র যে পরিমান সম্পত্তি পাবে, কন্যা তার অর্ধেক পরিমাণ পাবে। তবে যদি কন্যা না থাকে বাকী সম্পত্তি সম্পূর্ণ অংশ পুত্র পাবে।
৬) কন্যা : মৃতের কন্যা তিন নিয়মে মৃতের সম্পদ পেয়ে থাকে। যথা-
ক) যদি মৃত ব্যক্তি একজন কন্যা থাকে তবে সে সম্পদের দুই ভাগের এক ভাগ (১/২) পাবে।
খ) যদি মৃত ব্যক্তির একাধিক কন্যা থাকে। তবে সব কন্যা একত্রে তিন ভাগের দুই ভাগ (২/৩) সম্পত্তি পাবে।
গ) যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র কন্যা উভয়েই থাকে। তবে পুত্র যে পরিমাণ সম্পত্তি পাবে, কন্যাগণ তার অর্ধেক পাবে।
অন্যান্য উত্তরাধিকারসমূহ
৭) আপন ভাই : কোন ব্যক্তির কোন পুত্র না থাকিলে স্ত্রী, তার কন্যা বা কন্যাদ্বয়কে সম্পত্তির পর্যাপ্ত হিস্যা বুঝাইয়া দিয়ে অবশিষ্ট অংশ ভাই পাবেন যদি মৃত ব্যক্তির কোন পুত্র সন্তান বা পুত্রের পুত্র থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির ভাই তার সম্পত্তির কোন ভাগ পাবেন না।
৮) আপন বোন : আপন ভাই একজন থাকলে এককভাবে ১/২ অংশ এবং একাধিক আপন বোন থাকলে একত্রে ২/৩ অংশ পান। কিন্তু আপন ভাইয়ের অস্থিত্ব থাকলে ভাইয়ের সঙ্গে অবশিষ্টাংশ ভোগী হিসাবে ২:১ হারে সম্পত্তি পান। কিন্তু মৃত ব্যক্তির সন্তান বা পুত্রের নিম্নগামী সন্তান, পিতা বা পিতার উর্ধ্বস্থিতিতে আপন বোন উত্তরাধিকারী হতে বাদ পড়ে। এমনকি মৃত ব্যক্তির এক বা একাধিক কন্যা বা পুত্রের কন্যা উপস্থিতিতে ও আপন বোন উত্তরাধিকার হতে বাদ পড়ে।
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন ১৯৬১ সালের আগে উক্ত আইনটি বিধিবদ্ধ ছিল না। পরবর্তীতে আইন পাশ করে এই উত্তরাধিকার আইনটি চালু করা হয়। উক্ত আইনের আলোকে সংশ্লিষ্ট উত্তরাধিকারদের সঠিকভাবে অংশ উল্লেখপূর্বক বন্টন করা বাধ্যগত নির্দেশনা দেয়া আছে। আবার মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে কোন সন্তানকে ত্যাজ্য বলে ধরা হয় না। তাই কখনো ত্যাজ্য ঘোষনাকৃত সন্তানকে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না। তবে কোন ব্যক্তি বেজিষ্ট্রীকৃতভাবে সম্পত্তি দান বা হস্তান্তর করে গেলে এবং সন্তানকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে সন্তানের অংশ উল্লেখ না করে গেলে ঐ সন্তান আর সম্পত্তি পাবে না। সৎ ছেলেমেয়ে, সৎবাবা বা সৎ মায়ের সম্পত্তি পায় না। এইকভাবে সৎবাবা বা সৎ মা, সৎ ছেলেমেয়ের সম্পত্তি পায় না। কেউ কাউকে হত্যা করলে হত্যাকারী সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। মৃত ব্যক্তির কোন উত্তরাধিকার না থাকলে এবং তা তিনি জীবিতকালে কাউকে দেয়ার ব্যবস্থা করে না গেলে সরকার তার সম্পত্তির ওয়ারিশ বলে বিবেচিত হবে। উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখলে তা অহেতুক বিবাদ বা মামলা মোকদ্দমা হতে অংশীদারদের বিরত রাখে। উত্তরাধিকার আইনের সঠিক প্রয়োগ উত্তরাধিকারীদের মাঝে সম্পত্তি বন্টনের জটিলতা দূর করে থাকে।
লেখক : আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম