মুমিন বান্দার গুণাবলি

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ২৮ নভেম্বর, ২০২৫ at ৯:৩৫ পূর্বাহ্ণ

মহান রাব্বুল আ’লামিন মুমিন বান্দাদের জন্য তাঁর পবিত্র কালামে পাকে অনেকগুলো গুণাবলী বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে সূরাআল ফুরকানে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দয়াময় (আল্লাহতায়ালা) এর বান্দা তো হচ্ছে তারা, যারা জমিনে নেহায়াত বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং যখন জাহেল ব্যক্তিরা (অশালীন ভাষায়) তাদের সম্বোধন করে, তখন তারা নেহায়াত প্রশান্তভাবে জবাব দেয়’। মুমিন বান্দারা ভূপৃষ্ঠে বিনয়ী ও নম্রতার সাথে চলাফেরা করেন। তারা গর্বঅহংকার, ঝগড়াফাসাদ এবং জুলুমঅত্যাচার করে না। যেমন: হযরত লোকমান (আঃ) তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, ‘এবং পূথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ কর না‘ সূরালোকমান১৮। কৃত্রিমভাবে কোমড় বাঁকিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে, রুগ্ন ব্যক্তির মত পায়ে পায়ে চলা এখানে উদ্দেশ্য কখনো নয়। এটা তো রিয়াকারদের কাজ। তারা লোকদেরকে দেখানেরা জন্য এবং দুনিয়ার দৃষ্টি তাদের দিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে এরূপ করে থাকে। রাসূল (সাঃ) এর অভ্যাস ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি এমনভাবে চলতেন যে, মনে হত যেন তিনি কোন উঁচু যায়গা থেকে নিচে নামছেন এবং যেন জমিনকে তাঁর জন্য জড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। এখানে উদ্দেশ্য হল: শান্ত এবং গাম্ভীর্যের সাথে ভদ্রভাবে চলা, দূর্বলতা ও অসুস্থতার ডঙ্গে নয়। যেমন: রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যখন তোমরা সালাতের জন্য এসো তখন দৌঁড়ে এসো না, বরং শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে এসো। জামাতের সাথে যা পাবে তা আদায় করে নাও এবং যা ছুটে যাবে তা পুরো করে নাও। এরপরে আল্লাহতায়ালা বলেন, মূর্খ লোকেরা যখন তাদের সাথে মূর্খতাপূর্ণ কথা বলেন, তখন তারা এই মূর্খদের সাথে তদ্রুপ আচরণ করে না বরং তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়। যেমন: রাসূল (সাঃ) এর অভ্যাস ছিল এই যে, কোন লোক যতই তাকে কড়া কথা বলতততই তিনি তাকে নরম কথা বলতেন। যেমন: আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ তারা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে তখন তা উপেক্ষা করে চল’ সূরা কাসাস৫৫। এরপরে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা তাদের মালিকের উদ্দেশ্যে সাজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান থেকে রাতগুলো কাটিয়ে দেয়’। তারা বিছানা থেকে পৃথক হয়ে যায়। তাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় বিদ্যমান থাকে। আল্লাহতায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘তারা রাতের সামান্য অংশ অতিবাহিত করত নিদ্রায়, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত’। সূরা যারিয়াত১৭,১৮। তিনি অন্যত্র বলেন, ‘তারা শয্যা ত্যাগ করে’সূরা সাজদা১৬। এর পরের আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ যারা বলেন, হে আমাদের মালিক, তুমি আমাদের থেকে জাহান্নামের আযাব দূরে রাখ, কেননা তার আযাব হচ্ছে নিশ্চিত বিনাশ। হযরত হাসান (রহঃ) বলেন, যে জিনিস আসে ও চলে যায় তা গারামা নয়। গারামা হল ঐটাই যা আসার পরে আর চলে যায় না বা সরে যায় না। আদম সন্তান দৈনন্দিন যে শাস্তির সম্মুখিন হয় তা তো ক্ষনিকের জন্য, এটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না কিছুক্ষণ কিংবা কিছুদিন পর তার ফলাফল শেষ হয়ে যায়। স্থায়ী শাস্তি হলো তা, যার কোন বিরাম নেই, যেই শাস্তিকে পূথক করা যায় না এবং যা আকাশ ও পৃথিবী স্থায়ী থাকা পর্যন্ত চলতে থাকবে। এর পরের আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ আশ্রয় ও থাকার জন্য তা হল একটি নিকৃষ্ট জায়গা’। এর পরের আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা যখন ব্যয় করে তখন অপব্যয় যেমন করে না কার্পণ্যও তারা করে না বরং তাদের ব্যয় মধ্যবর্তী অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে’। এই আয়াতের বিপরীতে আল্লাহতায়ালা অন্যত্র বলেন,‘ তুমি বদ্ধমুষ্টি হইও না এবং একেবারে মুক্তহস্তও হইও না’ সূরা ইসরা২৯। আল্লাহতায়ালা মুমিন বান্দাদের আরেকটি গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, ‘ এইভাবে যারা আল্লাহতায়ালার সাথে অন্য কোন মাবুদকে ডাকে না, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে যাকে হত্যা করতে আল্লাহতায়ালা নিষেধ করেছেন তাকে যারা হত্যা করে না, যারা ব্যভিচার করে না, যে ব্যক্তি এসব (অপরাধ) করবে সে তার গুনাহের শাস্তি ভোগ করবে’। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হয় সবচেয়ে বড় পাপ কোনটি: তখনি তিনি বলেন, আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করা, অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন: তারপর কোনটি? জবাবে তিনি বলেন, তুমি তোমার সন্তানকে এ ভয়ে হত্যা করবে যে, সে তোমার সাথে খাদ্য খাবে। পুনরায় লোকটি প্রশ্ন করে: তারপর কোন পাপটি সবচেয়ে বড়? তিনি উত্তর দেন: ঐ পাপটি এই যে, তুমি তোমার প্রতিবেশির স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়বে। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, উক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর উক্তিকে সত্যায়িত করা হয়েছে। সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রহঃ) বলেন, তিনি ইবনে আব্বাসকে (রহঃ) বলতে শুনেছেনঃ ‘মুশরিকদের কতক লোক রাসূল (সাঃ) এর নিকট আগমন করেন যারা বহু হত্যাকার্য ও ব্যভিচার করেছিল। তারা বলেন: হে মোহাম্মদ (সাঃ) আপনি যা কিছু বলছেন এবং যে দিকে আহবান করছেন তার সবই উত্তম ও সত্য। কিন্তু আমরা যেসব পাপকার্য করেছি সেইগুলোর ক্ষমা আছে কি? ঐ সময় উক্ত আয়াতটি নাজেল হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন যে, আছামা হল জাহান্নামের একটি উপত্যকা, ওখানে অবৈধ ও যৌনাচারে লিপ্ত লোকদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে। এর পরের আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কেয়ামতের দিন তার জন্য এই শাস্তি আরও বাড়িয়ে দেওয়া হবে, সেখানে সে অপমানিত হয়ে চিরকাল পড়ে থাকবে’ অর্থাৎ তাকে বিরামহীন শাস্তি দেওয়া হবে এবং শাস্তির কঠোরতাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করা হবে। এর পরের আয়াতে আল্লাহতায়ালা সুখবর দিয়ে বলছেন, ‘কিন্তু যারা তওবা করেছেন, (আল্লাহর উপর) ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, আল্লাহতায়ালা এমন সব লোকদের গুনাহসমূহ তাদের নেক আমল দ্বারা বদলে দিবেন আল্লাহতায়ালা ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’। এই আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, হত্যাকারীর তওবাও গ্রহণযোগ্য। সহীহ হাদীস দ্বারা হত্যাকারীর তওবা কবুল হওয়া প্রমাণিত। যেমন: ঐই লোকটির ঘটনা, যে ১০০ লোককে হত্যা করেছিল এবং তারপর তওবা করেছিল এবং আল্লাহতায়ালা তার তওবা কবুল করেছিলেন (বুখারী৩৪৭০, মুসলিম৭০০৮)। হযরত আবু যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন: যে ব্যক্তি সর্বশেষে জাহান্নাম থেকে বের হবে এবং সর্বশেষে জান্নাতে প্রবেশ করবেন তাকে আমি চিনি। সেই হবে ঐ ব্যক্তি যাকে আল্লাহতায়ালার সামনে আনা হবে। আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিবেন: তার বড় বড় পাপগুলো ছেড়ে দিয়ে ছোট ছোট পাপগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কর। সুতারাং তাকে প্রশ্ন করা হবে: অমুক দিন কি তুমি অমুক কাজ করেছিলে? অমুক অমুক পাপ তুমি করেছিলে কি? সে একটিও অস্বীকার করতে পারবেন না, বরং সবটাই স্বীকার করে নিবে। শেষে আল্লাহতায়ালা তাকে বলবেন: তোমার পাপের পরিবর্তে তোমাকে সাওয়াব দান করা হল। তখন সে বলবে: হে আমার রব! আমি আরও কতগুলো কাজ করেছিলাম যেগুলো এখানে দেখছি না? আবূ যার (রাঃ) বলেন যে, এ কথা বলার পর রাসূল (সাঃ) এমনভাবে হেসে ওঠেন যে, তাঁর দাঁতের মাড়ি দেখতে পাওয়া যায় (আহমেদ/১৭০, মুসলিম ১/১৭৭)

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),

রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধরেস্তোরাঁর নিস্তব্ধ টেবিলে
পরবর্তী নিবন্ধবহুভাষী সুরের জাদুকর : জুবিন গার্গ